সহায় সম্বলহীন এক গরিব পোস্টমাস্টার মুক্তিযোদ্ধা গৌর গোপাল গোস্বামীর পরিবারের মাথা গোঁজার ঠাঁইটুকু কেড়ে নিয়েছে সন্ত্রাসীরা। রাতের অন্ধকারে নির্যাতন, লুটপাট, জিনিষপত্র ভাংচুর করে জোর করে ট্রাকে তুলে দিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে তাদের। অভিযোগ করা হয়েছে থানায়। থানা পুলিশের ঢিলেঢালা গা ছেড়ে দেয়া ভাবে প্রতিকার পাচ্ছে না এই পরিবারটি। এমন ঘটনা বগুড়া শহর থেকে মাত্র দশ কিলোমিটার দক্ষিণের মাদলা গ্রামের। বগুড়া মাদলা এলাকাতেই গৌর গোপাল গোস্বামীর পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া কিছু জায়গার জমি ছিল এক সময়। সেগুলো শরিকরা বিক্রি করে দেয় অনেক আগে। সম্বলহীন গৌর গোপাল চাকরি পায় পোস্টমাস্টারের। তার কর্মস্থল সোনাতলা। স্ত্রী অর্চনা গোস্বামী ২ ছেলে ১ মেয়ে নিয়ে সংসার তার। মেয়ের বিয়ে হয়েছে বছর কয়েক আগে। এক ছেলে চাকরি করে পুলিশে। আরেক ছেলে সঙ্গেই থাকে। গৌর গোপাল গোস্বামী মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ মাদলা ইউনিয়ন কমিটির কমান্ডার। তার নিজের কোন বাড়িঘর না থাকায় বছর দুয়েক আগে ’৯৯ সালে মাদলা ইউনিয়নে সমবায় সমিতির কাছ থেকে তিন বছরের চুক্তি মূলে মাসিক ভাড়ার ভিত্তিতে ছোট একটি বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। স্বাধীনতার আগে এই ইমারতটির পরিচিতি ছিল মাল্টিপারপাস সোসাইটি বিল্ডিং নামে। পরবর্তীতে সেখানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কার্যক্রম চলে কিছুদিন। এরপর একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকও ভাড়া নিয়ে থাকে কিছুটা সময়। পরে এক সময় ওই এলাকার একটি ক্লাব সেখানে সাইনবোর্ড ঝুলায়। এভাবে চলার পর মাদলা ইউনিয়নে সমবায় সমিতির নিয়ন্ত্রণে একটি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সমিতির অধীনে বাড়িটি থাকে। ’৯৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গৌর গোপাল গোস্বামীকে মাসিক ভাড়ায় তিন বছরের জন্য অর্থাৎ ২ হাজার ২ সাল মেয়াদ পর্যন্ত বসবাসের জন্য বাড়িটি দেয়া হয়। গত শনিবার ১৩ অক্টোবর এলাকার প্রভাবশালী এক ব্যক্তির ছেলের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা বাড়িটি দখলের লক্ষ্য হামলা চালায়। এ সময় সন্ত্রাসীরা গৌর গোপাল গোস্বামীকে মারধর করে ও ঘরের জিনিষপত্র ভাংচুর করে। গৌর গোপাল ও অর্চনা জানান জিনিষপত্র ভাংচুরের সময় সন্ত্রাসীরা লুটপাটও করে। তাদের (গৌর গোপাল) অনেক মূল্যবান জিনিষ (সোনার গহনাসহ) লুট হয়ে যায়। রাত ৯টার দিকে সন্ত্রাসীরা গৌর গোপাল গোস্বামীর পরিবারকে ভাংচুর করা জিনিষপত্রসহ একটি ট্রাকে তুলে দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। এ ঘটনায় গৌর গোপাল গোস্বামীর স্ত্রী অর্চনা গোস্বামী বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় একটি অভিযোগ দায়ের করলে থানারও গড়িমসি শুরু হয়। ঘটনার দু’দিন পর অভিযোগটি এন্ট্রি হয় ঠিকই তবে পুলিশের গা ছেড়ে দেয়া ভাবে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সন্ত্রাসী ও উচ্ছেদকারী কাউকে আটক করা যায়নি। ওই ঘটনায় ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগ দায়ের করা হয়। এ ব্যাপারে মাদলা ইউনিয়নের এক সূত্র জানায়, গৌর গোস্বামী ও অর্চনা গোস্বামী লিখিত দিয়ে স্বেচ্ছায় চলে গেছেন। এ বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে গৌর গোস্বামী ও অর্চনা গোস্বামী জানিয়েছেন ঘটনার দিন বিকেলে মালদা ইউনিয়নের ঘরে তাদের ডেকে নিয়ে জোর করে একটি কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়া হয়। ওই কাগজে কি লেখা ছিল তা তারা (গৌর-অর্চনা) জানেন না। অন্যদিকে গৌর গোপাল গোস্বামীর কাছে ভাড়া চুক্তির যে ডিড আছে তাতে ২০০২ পর্যন্ত বসবাসের মেয়াদ আছে। এদিকে ঘটনাস্থল থেকে যে সব তথ্য পাওয়া যায় তাতে ওই এলাকার এক প্রভাবশালী ব্যক্তি (যিনি ইউনিয়ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি) গৌর গোপাল গোস্বামীর ভাড়া থাকা বাড়িটি দখলে নেয়ার চেষ্টা করছিল। ইতোপূর্বে সন্ত্রাসীরা সেখানে হামলা চালায়। এলাকাবাসীর প্রতিরোধের মুখে সে সময় তারা দখল নিতে পারেনি। তাছাড়া তিন বছরের চুক্তিতে গৌর গোস্বামী পরিবার পরিজন নিয়ে বাস করায় এলাকার লোকজনের সহানুভুতি তাদের ওপর থাকে। ইলেকশনের পর এলাকার ওই প্রভাবশালী ব ̈ক্তি সমবায় সমিতির ওই ঘরটি দখলের পাঁয়তারা জোরেশোরে শুরু করে দেয়। গত শনিবার রাতে শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের দিয়ে দখল করেই নেয়। এক মুক্তিযোদ্ধার ঘর এভাবে দখলে যাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা সংসদও কোন উদ্যেগ নেয়নি। এ ব্যাপারে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্র বলেছে তারা বিষয়টি অবগত। এদিকে বেষ্ট নামের একটি মানবাধিকার সংস্থা ভিকটিমদের আইনগত সহায়তা দিতে রাজি হয়েছে।
দৈনিক জনকন্ঠ, ১৮ অক্টোবর ২০০১