নির্বাচন এলেই আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতা দেখা দেয় বানারীপাড়ার চারটি গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কোন নির্বাচনেই এ চারটি গ্রামের মানুষ সহজে ভোট দিতে পারে না। এসব গ্রামের মানুষ যাতে ইচ্ছেমতো ভোট দিতে না পারে সেজন্য থাকে সতর্ক প্রহরা। এখন থেকেই তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, হুমকি দেয়া হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এবারও বোধহয় তাদের ভোট দেয়া সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে এলাকায় নেতৃস্থানীয়দের ওপর মামলা শুরু হয়েছে। এক মুক্তিযোদ্ধা ও নারী ইউপি সদস্য এলাকা ছেড়ে প্রাণভয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। আরও অনেকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হয়রানির অভিযোগ বিএনপির স্থানীয় ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। বানারীপাড়া থানার চারটি গ্রাম সরেজমিন ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বরিশাল থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরের উপজেলা বানারীপাড়া। সেখান থেকেও কয়েক কিলোমিটারের পথ বাইশারী ইউনিয়ন। প্রমত্তা সন্ধ্যা নদী পেরিয়ে যেতে হয় সেখানে। এ ইউনিয়নের পশ্চিম বাইশারী, দক্ষিণ বাইশারী, ডুমুরিয়া, দত্তপাড়া গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এখন চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছে। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নানা কাহিনী। তারা এতই আতঙ্কগ্রস্ত যে, মুখ খুলতে পর্যন্ত সাহস পায় না। তাদের অভিযোগ, এ নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি হলে তাদের ওপর আরও বেশি নির্যাতন চলবে। অনেকেই অনুরোধ করেছেন রিপোর্ট না করার জন্য। তার পরও যারা কথা বলেছেন, অনুরোধ করেছেন নাম প্রকাশ না করার জন্য। এলাকার একটি চিহ্নিত মহলের ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছে সন্ত্রাসবাহিনী। এলাকায় এ বাহিনী বিচ্ছুবাহিনী নামে পরিচিত। একটি রাজনৈতিক নেতা এ বাহিনীকে মদদ দেয়। নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকেই অত্যাচার শুরু হয়েছে বলে জানান গ্রামের অনেকে। বাইশারী ইউনিয়নের পশ্চিম বাইশারী গ্রামের বাসিন্দা ও নারী ইউপি সদস্য অরুণাবালা আলো রাণীকে গত ১৭ জুলাই সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে বিচ্ছুবাহিনীর সদস্যরা পশ্চিম বাইশারী গ্রামের প্রবেশমুখে বাইশারী ব্রিজের কাছে গতিরোধ করে। অরুণাবালা আলো রাণীর কাছে ত্রিশ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে না পারলে তাঁর ননদদের একজনকে তাদের কাছে দিয়ে যেতে বলে। ১৮ জুলাই খুব ভোরে অরুণাবালা আলো রাণী প্রাণভয়ে চুপিসারে নৌকায় এলাকা ত্যাগ করেন। তাঁর ননদরাও চলে যান বানারীপাড়া। বিষয়টি জানানো হয় বানারীপাড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কান্তি পাল ও ওসি নাঈমুর রহমানকে। কিন্তু প্রশাসন এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা নেয়নি। এলাকার পরিস্থিতি সাংবাদিকদের বলার অপরাধে হামলার শিকার হয়েছেন কলেজ শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা শ্যামল চক্রবর্তী। স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে জানা গেলো, শ্যামল চক্রবর্তীর বাড়িতে ৫ আগস্ট দুপুর আড়াইটায় হামলা করে বিএনপির মদদপুষ্ট ঐ সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীরা তাঁকে মারধর শুরু করলে স্ত্রী এসে বাঁচাতে চেষ্টা করেন। দু’জনকেই তারা মারধর করে। সন্ত্রাসীরা শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, ঐ বাড়ি থেকে লুট করে নিয়ে গেছে মূল্যবান স্বর্ণালংকার ও অন্য মালামাল। শ্যামল চক্রবর্তী জখম অবস্থায় প্রাণভয়ে চিকিৎসার জন্য বের হতে সাহস পর্যন্ত করেননি। কয়েকদিন পর তিনি বরিশাল চলে যান চিকিৎসার জন্য। তার পর আর বাড়ি ফেরেননি। যারা ঐ বাড়িতে হামলা করেছে তারা বিএনপির কর্মী নয় বলে স্থানীয় বিএনপির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা দাবি করেছেন। তিনি জানান, হামলাকারীরা পেশাদার সন্ত্রাসী। তবে তিনি স্বীকার করেন, স্থানীয় বিএনপির কেউ হয়ত তাদের এ ঘটনা ঘটাবার জন্য ব্যবহার করে থাকতে পারে। চিহ্নিত এই সন্ত্রাসীদের হামলার শিকার হয়েছে পল্লী চিকিৎসক মুজিতকুমার দাস, পশ্চিম বাইশারীর দুলাল মিস্ত্রি, স্কুলছাত্র শুকলাল, বঙ্কিম মুহুরি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডুমুরিয়ার এক ব্যক্তি জানান, তিনি একমাত্র ইউপি নির্বাচন ছাড়া আর কোন নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। সেটাও সম্ভব হয়েছে মাদারীবাড়ী কেন্দ্র হওয়ায়। বাইশারী কেন্দ্র হলে তিনি ভোট দিতে পারতেন না বলে জানান। গত ’৯৬-র নির্বাচনের একটি ঘটনা উল্লেখ করে তিনি জানান, নিরঞ্জন ব্যাপারী বিএনপি করতেন। বাইশারী কেন্দ্রে তিনি প্রকাশ্যেই বিএনপির প্রার্থীকে ভোট দেন। ভোট দিয়ে তিনি গ্রামের সংখ্যালঘু ভোটারদের নিয়ে কেন্দ্রে থেকে আসার সময় বিএনপি ক্যাডাররাই তাকে বেধড়ক মারধর করে। ফলে আর যাঁরা ভোট কেন্দ্র রওনা হয়েছিলেন তাঁরা প্রাণভয়ে বাড়িতে ফিরে আসেন। ডুমুরিয়ার এক ব্যক্তি জানান, তিনি গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের একটিতেও ভোট দিতে পারেননি।
এমনকি ’৯৬-র নির্বাচনের দিন বাড়ি থেকেই বের হতে পারেননি। তিনি আরও জানান, নির্বাচনের সময় গ্রামে সন্ত্রাসীরা রাতে এসে কেন্দ্রে যেতে নিষেধ করে। তা ছাড়া নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকেই বোমাবাজি করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়।
পশ্চিম বাইশারী ও ডুমুরিয়ায় প্রায় দেড় হাজার সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছে। দত্তপাড়া গ্রামেও সন্ত্রাস চলছে। যাকে-তাকে মারধর করা হচ্ছে। বানারীপাড়া বাজারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী আমাদের জানান, খাবার আনার জন্য প্রতিদিন এক কর্মচারি তার বাড়িতে যায়। তাকে পর্যন্ত মারধর করা হয়েছে, হুমকি দেয়া হয়েছে। সেই কর্মচারী এখন আর দত্তপাড়া যেতে চায় না।
সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে ঐ গ্রামের বেশ কিছু কিশোরীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ ছিল। কয়েকদিন আগে থেকে আবার দু’একজন করে যেতে শুরু করেছে। সন্ত্রাসীদের ইচ্ছা অনুযায়ী ভোট না দিলে গ্রামে থাকতে দেবে না বলে হুমকি দেয়া হয়েছে। এ গ্রামের ত্রিনাথ, অসীম, সুমন সন্ত্রাসীদের ভয়ে এখন গ্রাম ছেড়ে বানারীপাড়া উপজেলা সদরে আশ্রয় নিয়েছে। সম্প্রতি এ গ্রামের দিলীপ ঠাকুর,গোপাল ঠাকুরের কাছে এই সন্ত্রাসী ১০ হাজার টাকা করে চাঁদা দাবি করেছে। এদের কয়েকজন কালীবাড়ীর মনসা মন্দিরের লোহা কাঠের চৌকাঠ খুলে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া যেসব সংখ্যালঘু পরিবার গ্রামের বাইরে থাকে তাদের বাড়ির জিনিসপত্র এরা নিয়ে যায়। ’৯১-এর নির্বাচনে এ গ্রামে সংখ্যালঘু ভোটার ছিল প্রায় চারশ’। কিন্তু এখন অর্ধেক ভোটারও নেই। বহু পরিবার ইতোমধ্যে এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।
দৈনিক জনকণ্ঠ, ৩০ আগস্ট ২০০১
কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন