পত্রিকায় কিছু লেখার দরকার নেই। কাউকে বলতে চাই না, আমাদের জীবনে কি ঘটে গেছে। কোনো বিচার চাই না, ক্ষতিপুরণ চাই না। কেউ দিতেও পারবে না। আপনারা শুধু প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বলবেন, আমাদের কোনো উপায় নেই, কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আমরা এদেশেই থাকতে চাই। শুধু তিনি যেন আমাদের বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করেন, আমরা একটু শান্তি চাই। তাকে বলবেন, মা-মেয়ে যেন নিরাপদে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারি। আমাদের স্বামী, ছেলেমেয়েদের নিয়ে দুবেলা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকতে চাই। আমরা রাজনীতি করি না, ভোট দিতে যাইনি। ভবিস্যতেও কোনোদিন ভোট দেবো না। আপনাদের মাধ্যমে তাকে কথা দিলাম। তিনি যেন শুধু আমাদের দিকে একটু করুণা করেন। আমরা এদেশেরই মানুষ। আর কতোকাল নিজ দেশে পরবাসী থাকবো? এতো অত্যাচার, নির্যাতন আর সহ্য হয় না। এমন যন্ত্রণা বুকে নিয়ে বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। না পারি কাউকে বলতে, না পারি কাউকে দেখাতে। শুধু ঈশ্বর জানেন আমরা কেমন আছি। স্বামী, সন্তান, ছেলেমেয়ে কে কোথায় আছে জানি না। আর কতোকাল এভাবে থাকতে হবে? খালেদা জিয়াকে একটু বলবেন আমাদের কথা। কান্নাজড়িত কন্ঠে নিচু গলায় নিচের দিকে তাকিয়ে শুধু এটুকু বলার পর আর কিছুই বলতে পারলেন না পরেশ চন্দ্র মিস্ত্রী প্রভা রাণী (৪০)। ভোলা জেলার দৌলত খান উপজেলার লেজপাতা গ্রামের একজন প্রভা রাণীর কান্নার সুরে সুর মিলিয়েছে ওই এলাকার শত শত মা। প্রভা রাণীর কথা শেষ হলে স্বামী পরেশ চন্দ্র মিস্ত্রী কিছু বলতে চাইলেন। খালি গায়ে একটা চাদর পরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে ছিলেন এতোক্ষণ। দৃষ্টি তার দূর আকাশের দিকে। চোখের জল লুকানোর জন্যই অন ̈দিকে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। পরেশ চন্দ্র বললেন, আমাদের অসহায়ত্ব কাপুরুশের চেয়েও নিচে নেমে গেছে। ঘরের জিনিসপত্র সব নিয়ে যাওয়ার পর স্ত্রী, মেয়ে, পুত্রবধূকে নির্যাতন করলো আমারই সামনে। স্ত্রী বাড়ির পাশে পুকুরে লুকিয়ে ছিলো শুধু নাক উঁচু করে, সেখান থেকে তাকে ধরে এনেছে। পুত্রবধূ ছয় মাসের মেয়েকে কোলে নিয়ে বাড়ির পেছনে সুপারি বাগানে লুকিয়ে ছিলো, বাচ্চার কান্নার শব্দে পশুদের কান খাড়া হয়ে যায়, সেখানে ছুটে গিয়ে পুত্রবধূ আর কলেজ পড়ুয়া মেয়েকে নির্যাতন করলো দলবেঁধে। কিছুই বলতে পারিনি। গলার ওপর রামদা ধরে রেখেছে। তা না করলেও কিছুই বলার ছিলো না, এখনো নেই, প্রতিবাদ করলে বাপ-দাদার মাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে। পরেশ চন্দ্র বললেন, ঘটনার পরদিন ৩ অক্টোবর নাজিউর রহমান মঞ্জুর, নতুন এমপি, মোশাররফ হোসেন শাহজাহান, কর্নেল ইব্রাহিম এসেছিলেন। তাদের কাছে বলেছি, তারা শুনে চলে গেছেন। পরে আবার রাতে এসে গালাগাল করেছে যারা নির্যাতন করেছে। আমাদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কাউকে পাচ্ছি না । পরেশ চন্দ্র বললেন, নির্বাচনের আগের দিন বাড়িবাড়ি এসে কিছু লোক বলে গেছে আমরা যেনো ভোট দিতে না যাই। আমরা যাইনি। তারপরও কেনো এই নির্যাতন? নির্বাচনের পরের দিন ২ অক্টোবর রাতে নির্যাতনের চরমসীমা লঙ্ঘন করে পশুর দল। ওরা মানুষ নয়, কোনো দলের নয়, ওদের কোনো মা-বোন নেই, থাকতে পারে না। ওরা কোনো মায়ের গর্ভেও জন্ম নেয়নি। যদি তা হতো তাহলে নগদ টাকা চাঁদা আদায়, বাড়িঘর লুটের পর অসহায় মা-বোনদের ওপর এভাবে হামলে পড়তে পারে না। পরেশ চন্দ্র বললেন, আমরা ওদের চিনি না, চিনলেও নাম বলবো না। বলে কোনো লাভ নেই। যাদের ক্ষমতা আছে ওদের শাস্তি দেয়ার তারাই চেনে ওদের। যদি কিছু করার ইচ্ছে থাকে তাহলে আমাদের মুখ দিয়ে নাম বলানোর কোনো দরকার নেই। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে ওই বাড়িরই মনোরঞ্জন সরকার বললেন, আমরা যা পরে আছি তাই আছে। আর কিছুই নেই, সব নিয়ে গেছে। ওরা রিকশা এবং ভ্যান নিয়ে এসেছিলো। বস্তায় করে আমাদের সব নিয়ে গেলো। স্ত্রী, কন্যা, পুত্রবধূর ওপর নির্যাতন করলো। এখনো আমাদের রাস্তায় ওঠা নিষেধ। এ বাড়ির ১৩টি ঘরের সবকটি ঘরেই লুটপাট হয়েছে। যারা বাড়িতে ছিলো সবাইকে মেরেছে, নির্যাতন করেছে। সুরেশ চন্দ্র সরকার (৬০) বললেন, পাশের বাড়ির শামসুদ্দিন মওলানা এবং নুরানী হুজুরের আশ্রয়ে এখন আমরা আছি। রাত হলে মহিলারা ওই বাড়িতে থাকে। থালা-বাসন কিছুই নেই। তাদের দেয়া হাঁড়ি-বাসনে খাওয়া দাওয়া করি। আমাদের আশ্রয় দেয়ার কারণে তিনি এখন হুমকির মুখে। কারণ তার পাশে দাঁড়ানোর মানুষ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে তিনি প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। পশ্চিম লেজপাতা গ্রামের হারান চন্দ্র বালা (৬০) মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের যতো মানুষ আছে তারা সবাই মিলে এখানে প্রতিবছর পূজা করি। এবার নির্বাচনের আগে থেকেই চাঁদাবাজি শুরু হয়। পুরুষ মানুষ, তরুণী, গৃহবধূ তখন থেকেই এলাকাছাড়া। পূজা কমিটির লোকজনও এলাকাছাড়া। এ কারণে এবার পূজার আয়োজন হয়নি। এখন বিএনপি নেতারা পূজা করার জন্য চাপ দিচ্ছেন, কিন্তু পূজা করতে হলে প্রতিমা বানানো দরকার, উৎসব করার জন্য লোকজন দরকার, মানুষের মনে আনন্দ দরকার, আমরা যে পরিস্থিতিতে আছি তারপরও পূজা করার কোনো পরিবেশ কি আছে? ভোলা এবং পটুয়াখালী জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে নারী-পুরুষের এ আর্তি শুনতে শুনতে কেটে গেছে চার দিন। বুকফাটা আর্তনাদ শুধু চাপা কান্নার মাধ্যমে প্রকাশ করেছে তারা। তাদের জীবনে ঘটে যাওয়া যতোসব ঘটনার কিছুই তারা বলতে পারছে না। ভোলা জেলার দৌলতখান, লালমোহন, চরফ্যাশন, পটুয়াখালী জেলার বাউফল, দশমিনাসহ বিভিন্ন থানার প্রতিটি ইউনিয়ন, গ্রামে গিয়ে বিচিত্র নরক যন্ত্রণায় ছটফট করতে দেখা গেছে অসংখ্য মানুষকে। কেউ নির্বাক, কেউ উন্মাদ হয়ে গেছে নিজের সামনে মেয়ে- স্ত্রী-পুত্রবধূকে নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে দেখে। কোনো প্রতিবাদ করতে পারেনি। আজও পারছে না। মামলা করার সাহস নেই কারও। এমনকি কাউকে বলতেও পারছে না। ধর্ষণ, লুটপাট, অত্যাচার, নির্যাতন দেখতে দেখতে উন্মাদ হয়ে গেছে সবাই। সর্বস্ব হারিয়ে নিথর নিস্তব্ধ শরীরে, নির্লিপ্ত নয়নে ঠাঁয় বসে আছে তরতাজা তরুণ। এতো অসহায় মানুষ এর আগে কখনো কেউ দেখেছে কিনা কে জানে।

সংবাদ, ২৩ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন