ভোলার দৌলত খান উপজেলার লেজপাতা গ্রামের সরকার বাড়িতে ২ অক্টোবর রাতে নির্যাতনের কি বাকি ছিল সে প্রশ্ন খোদ এলাকাবাসীর। সরকার বাড়িতে ১৩ ঘর। কোন ঘরেই মেয়ে মানুষ নেই। পুরুষরা এক কাপড়ে গামছা চাঁদর পরে দিন কাটাচ্ছেন। নির্যাতনের বীভৎস রূপ বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন পরেশ চন্দ্র মিস্ত্রীর স্ত্রী প্রভারাণী। রাত ৯টায় ২০/২৫ জনের একটি গ্রুপ প্রবেশ করে বাড়ির উঠানে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। বোমাতঙ্কে প্রভা রাণী ঘরের পিছনের পুকুরে লাফিয়ে পড়ে শুধু নাকটুকু উপরে রেখে পানির মধ্যে অবস্থান নিয়ে ইজ্জত বাঁচানোর শেষ চেষ্টা করে। কিন্তু মানুষরূপী নরপশুরা লাইট মেরে প্রভা রাণীকে চুলধরে টেনে তোলে পুকুর পাড়েই সর্বস লুটে নেয়। নাক থেকে খুলে নেয় সোনার ফুলটিও। এই বাড়ির চার যুবতি মেয়ে বীনা, পলি, মিলন ও শিপ্রারাণী দৌড়ে হোগলাপাতার বনে গিয়েও ইজ্জত বাঁচাতে পারেনি। রিঙ্কু নামের পাঁচ বছরের শিশু কন্যার নাঁক ছিঁড়ে নিয়ে গেছে স্বর্ণের নাককুলটি। পুরো এলাকায় চলছে নিঃশ্বদ কান্না। মঙ্গলবারের ঘটনা শুনে বুধবার এই বাড়িতে ছুটে গেছেন জাতীয় পার্টির নাজিউর রহমান মঞ্জুর, বিএনপির হাফিজ ইব্রাহিম এবং মোশারফ হোসেন শাহজাহান। তাঁরা হিন্দুদের আশ্বাস দিয়ে এসেছেন আর কিছু হবে না। কিন্তু তাঁদের প্রশ্ন ছিল হওয়ার আর কিইবা বাকি আছে। অবশ্য নেতাদের আশ্বাসের পর আর কোন অঘটন ঘটেনি। তবে আতঙ্ক কাটেনি। অক্টোবর বিকাল সোয়া পাঁচটায় সরকার বাড়িতে ঢুকতেই দেখি দরজায় দাঁড়িয়ে আছে মনোরঞ্জন সরকার এবং বিধান সরকার। বিধান, সরকারের পরনে শীতের চাঁদর এবং মনোরঞ্জন সরকারের পরনে ছিল নীল রঙের একটি গামছা। দু’জনই জানিয়েছেন, তাদের ঘটিবাটি বিছানাপত্র এমনকি পরনের লুঙ্গি এবং ধুতি পর্যন্ত নিয়ে গেছে। দুর্বৃত্তরা ভ্যান ও রিক্সা নিয়ে এসেছিল। সব ঘর থেকে জিনিসপত্র বের করে তারা বস্তা বোঝাই করে নিয়ে গেছে। সুন্নত আলীকে বেধড়ক পিটিয়েছে। যাবার সময় বলে গেছে, তোর বাবাগো কাছে কবি রাতে তোগো ছেওয়াইয়া যাব”। হামলা কারীদের চিনেন কিনা জিজ্ঞাসা করলে বলেন, চিনলেও চিনি না, বললে জান থাকবে না। সরকার বাড়ির পাশে কর্মকার বাড়ির পুকুর লুট করে মাছ নিয়ে গেছে। সরকার বাড়ীর সুন্নত আলীর কন্যা বীনা, মুকুন্দ বেপারীর কণ্যা পলি ও মনোরঞ্জন সরকারের কন্যা মিলন এবং বলরাম তেলীর কন্যা শিপ্রা রাণীর ওপর বাবা মায়ের সামনেই পাশবিক নির্যাতন চালিয়েছে দস্যুরা। এলাকার অরাজনৈতিক মুসলিম পরিবারগুলো হিন্দু মহিলাদের নিজেদের বাড়িতে আশ্রয় দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন। সরকার বাড়ির একটু সামনে বটতলা বাজারে এলে চায়ের দোকানে সমবেত মানুষ সমস্বরে বলে উঠেন, সত্য কথা লিখুন। ভাই এত ধর্ষণ ১৯৭১ সালেও দেখিনি। কয়েকজন নামাজী মানুষ মাথায় টুপি পরা, তারা এই প্রতিবেদককে প্রশ্ন ছুড়ে বলেন, ইসলাম কি এই সব নির্যাতন সমর্থন করে? তারা বলেন, ঘুনপোকা আক্রান্ত বিবেক দগ্ধ হবে অচিরেই। পরিপূর্ণ বিবেক চাই। বেলা চারটার দিকে চরপাড়া ইউনিয়নের অঞ্জুরাণী মেম্বরের বাড়িতে নিত্য হরি রায় জানান, নির্বাচনের আগের দিন মুখোশ পরে একদল যুবক ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য শাসিয়ে গেছে। প্রতিবাদ করেননি। প্রশ্নের জবাবে তার সাত-আট বছরের কিশোরপুত্র পরীক্ষিত বলেছে, প্রতিবাদ করলে বিপদ আছে। এলাকার নির্বাচিত মেম্বর অঞ্জু রাণীর ঘর থেকে ১৫ দিন আগেই লুট করে নেওয়া হয়েছে টেলিভিশন সহ সমস্ত আসবাবপত্র। নির্বাচনের ১৫ দিন আগে অঞ্জু রাণীকেও এলাকা ছাড়া করা হয়েছে। ২২ সেপ্টেম্বর মেরে ফেলা হয়েছে অঞ্জু রাণীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সহকারী বশিরকে। অঞ্জু রাণীর অপরাধ ছিল, তিনি নৌকার পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নেমেছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের পর মামলা হয়েছে। মৃত্যুর আগে বশির থানায় জিডিও করেছিল, কিন্তু আসামী ধরা পড়েনি। হাওলাদার বাড়ির পুষ্পাঞ্জলি হাওলাদার জানান, তাঁর চার ছেলে রেখে স্বামী মারা গেছে এক বছর আগে। ‘৯২ সালে বাবরী মসজিদের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। দু’ছেলে ঢাকা থাকে। বাকি দুজন বাড়ি থাকে, তারা বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। এই বাড়ির সুপারির বাগান, ঘর সব কিছু লুট করে নিয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, গত পাঁচ বছর তাদের মধ্যে কোন ভয় ও আতঙ্ক ছিল না। এখানকার আওয়ামী লীগের নেতারা সব পালিয়ে গেছে। পুলিশ মাঝেমধ্যে এসে ঘুরে যান তবে গিয়ে রিপোর্ট দেন কোন সমস্যা নেই। পুষ্পাঞ্জলি হাওলাদার জানান, ভারতে কোন আত্মীয় স্বজন বা যাওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। দাঁয়ের তলে মাছ হিসেবে এখন তাঁরা যে কদিন বেঁচে থাকতে পারেন। চরদুয়ানীতে হিন্দু যুবতীদের ওপর একের পর এক নির্যাতন হয়েছে। বিতৃষ্ণ হয়ে এখন তারা দিন রাত ঘরের দরজা খুলে রেখে অবস্থান করছে এবং একটি বাড়ির গেটে লিখে রেখেছে, যা খুশি কর। পাগলী বেশে রাস্তায় হাঁটছেন নূরজাহান বেগম। মাগো কি অবস্থা জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, তাঁর মালিক (তিনি যে বাড়িতে কাজ করেন হিন্দু বাড়ী) ১২ হাজার টাকা দিয়ে অত্যাচার থেকে রেহাই পেয়েছে। তিনি বলেন এসব কথা লিখবেন না, তাহলে ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। বালা বাড়িতে প্রতি বছর ধুমধামের সঙ্গে পূজা হয়। এবার পূজা মণ্ডপ খালি শুনে সেখানে গিয়ে দেখি পূজামণ্ডপের সামনে ব্যথিত কুকুর কাঁদছে। বালা বাড়িতেও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা এই বাড়িতে এসে কান্নাকাটি করে গেছে। এই বাড়িতে দুটি বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সব লুটপাট করে নিয়ে গেছে সন্ত্রাসীরা। এলাকার কয়েক হাজার হিন্দু ভোটারের কাউকেই ভোট দিতে দেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন হারান চন্দ্র বালা। ৫০ বছর বয়সী হারান চন্দ্র বালা জানান, তিনি এতদিন বাড়ি ছিলেন না, পালিয়ে বেড়িয়েছেন। তিনি প্রশ্ন করে বলেন, এভাবে আর কতদিন বাড়ি ঘর ছেড়ে পালিয়ে থাকব? পুরো এলাকায় হিন্দুদের নিঃশব্দ নীরব কান্না যেন প্রকৃতির বাতাসও ভারি করে তুলেছে। তাঁদের আক্ষেপ, কার কাছে বিচার চাইবেন।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৩ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন