রাজনৈতিক সহিংসতায় সন্ত্রস্ত জনপদ ভোলার মানুষ শঙ্কিত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আরো রক্ত ক্ষয়ের আশঙ্কায়। গত কয়েকদিন ধরে এখানে সন্ত্রাস-সহিংসতা চলছে অব্যাহতভাবে। গুলি ও বোমার শব্দ এখন
সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটারদের মধ্যে শঙ্কা আর সবার চেয়ে শতগুণ বেশি। জেলায় নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই একটি বিশেষ মহল সংখ্যালঘুদের
পরিকল্পিতভাবে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকার জন্য হুমকি দিয়ে আসছে। নির্বাচন যতোই এগিয়ে আছে তাদের ওপর চাপ ততোই বাড়ছে। গতকাল রোববার নির্বাচনের আগের দিন সরেজমিনে জেলার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত কয়েকটি এলাকা ঘুরে জানা গেছে, সন্ত্রাসীরা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে। স্থানীয় জেলা প্রশাসক এ ব্যাপারে সত্যতা স্বীকার করেছেন।
জেলা প্রশাসক কবির মোঃ আশরাফ আলমের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপকালে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যালঘুদের ওপর হুমকি ও নির্যাতনের বেশকিছু অভিযোগ তাদের কাছে এসেছে। প্রশাসনও বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোঃ কায়কোবাদ এবং তথ্য বিভাগের কর্মকর্তাসহ একটি দল জেলার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে তাদের অভয় দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানান। এ সময় তারা হ্যান্ডমাইক ব্যবহার করে এসব এলাকায় ১৬/১৭টি সভা করেন। এসব সভায় সখ্যালঘুদের নিরাপদে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া এবং নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার ব্যাপারে আশ্বস্ত করা হয়। পরে এলাকার হাটবাজারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এই প্রচারণা চালান।
এছাড়া নির্বাচনের নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত একটি সংস্থার সূত্র জানিয়েছে,নির্বাচনের দিন প্রয়োজনে প্রহরা দিয়ে সংখ্যালঘুদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসা হবে এবং বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বেশকিছু অপ্রীতিকর ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সংখ্যালঘু ভোটাররা প্রশাসনের এসব আশ্বাস বাণীতে ভরসা পাচ্ছেন না। শহরতলী পশ্চিম চরকালী চিন্তাহরণ দেবনাথের সঙ্গে কথা বলে সংখ্যালঘুদের ওপর ভীতি প্রদর্শনের একটি খণ্ড চিত্র পাওয়া যায়। তিনি বলেন, তার এলাকার অর্ধশতাধিক পরিবারের সবাইকে গত শনিবার রাতে সন্ত্রাসীরা ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য শাসিয়েছে। এ সময়
সন্ত্রাসীরা বলে, ভোট দিতে গেলে তোমাদের সর্বনাশ হবে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া হবে।
সংখ্যালঘুরা আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক হিসেবে পরিচিত বলে এসব সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগবিরোধী দলের নিয়োগ করা বলে তার ধারণা। একই অভিযোগ জানান পৌরসভার প্রাণকেন্দ্রের একটি এলাকার সংখ্যালঘু অধিবাসীরা। তারা বলেন, গত শনিবার রাতে স্থানীয় কিছু চিহ্নিত সন্ত্রাসী বহিরাগত কয়েকজন অস্ত্রধারীকে সঙ্গে নিয়ে তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দিয়ে বলেছে, ভোটকেন্দ্রে গেলে প্রত্যেকের হাতপায়ের রগ কেটে নেয়া হবে।
ভোলা-২ আসনের চরপাতা ইউনিয়নে তার নিজ গ্রামে গত এক মাস ধরে সংখ্যালঘুদের ওপর মারাত্মকভাবে অত্যাচার চালানো হচ্ছে। সন্ত্রাসীরা তাদের মারধর করছে এবং বিভিন্ন বাড়ির গোয়াল ঘর থেকে গরু-ছাগল ধরে নিয়ে যাচ্ছে। সন্ত্রাসীরা তাদের ভোটের আগের রাতেই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছে। অন্যথায় লাশ পড়বে বলে হুমকি দিয়েছে। এ গ্রামের অনেক পরিবার এখন ঘরছাড়া বলে তিনি জানান।
উল্লেখ্য, এ এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের মহিলা সদস্য অঞ্জলি রানী সাহার বাড়ি পাহারা দিতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ হারান মো. বশির। গত বুধবার রাতে তাকে প্রকাশ্যে রাস্তায় ফেলে জবাই করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। গত আড়াই মাসে ভোলায় নির্বাচনী সহিংসতায় কমপক্ষে ১৫ জন প্রাণ হারালেও পুলিশ এখন পর্যন্ত একটি হত্যাকাণ্ডেরও সুরাহা করতে পারেনি।
ভোলা ১, ২ ও ৩ আসনের আওয়ামী লীগ প্রার্থী সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ সংখ্যালঘুদের প্রসঙ্গে বলেন, সংখ্যালঘুদের আওয়ামী লীগের ভোটব্যাংক মনে করে বিরোধীপক্ষ তাদের ওপর সন্ত্রাস করে ভোটকেন্দ্রে আসতে নিরুৎসাহিত করছে। ভোলা-১ আসনের চার দল মনোনীত বিএনপি প্রার্থী সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোশাররফ হোসেন শাহজাহান এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ভোলা সদরে সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো ধরনের চাপ নেই।
প্রথম আলো, ১ অক্টোবর ২০০১
কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন