দেশের সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ এলাকা ফেনীর নির্বাচন ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। জেলার তিনটি নির্বাচনী এলাকার ২৭৩টি ভোট কেন্দ্রকে অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। কিন্তু দেশের অন্য আর দশটি কেন্দ্রের মতোই এখানেও পুলিশ-আনসার দিয়ে সাধারণ মানের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কোন কেন্দ্রে সেনাবাহিনী, বিডিআর সর্বক্ষণিকভাবে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে না। ফলে সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংশয়ের। এদিকে শনিবার রাতে একদল সন্ত্রাসী সেনা টহলের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে জেলার সার্বিক পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে।

সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা ভোটের আগেই এলাকা ছাড়ছে। সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশের অন্যান্য স্থানের মতো ফেনীতেও আজ সকাল আটাটা থেকে ভোট গ্রহণ শুরু হবে। চলবে চারটা পর্যন্ত। এ সময়ের মধ্যে ২৭৩টি কেন্দ্রে ছয় লাখ ৮৭ হাজার ৭২৭ জন ভোটারের ভোট প্রদান করার কথা। কিন্তু কেন্দ্রগুলোয় কঠোর অর্থাৎ সর্বক্ষণিকভাবে সেনা নিয়োগের মাধ্যমে নিরাপত্তা ব্যবস্থা না করায় তিন লাখ ৪৪ হাজার ৬২১ মহিলা ভোটারের মধ্যে অনেকেই ভোটকেন্দ্রে যাবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

জোট মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকরা ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার ব্যাপারে সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যদের হুমকি দেয়ায় প্রায় ৬৫ হাজার ভোটারের অধিকাংশ ভয়ে কেন্দ্রে যাবে না। ফলে মোট ভোটের বড় একটি অংশ কাস্ট না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ যেখানকার সন্ত্রাসীরা সেনাবাহিনীর টহলের ওপর গুলিবর্ষণ করতে পারে, তাদের কাছে পুলিশ-আনসারের নিরাপত্তা কিছুই না। সেনাবাহিনী ও বিডিআর এখানেও স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে থাকবে। কাজেই সন্ত্রাসীরা এখানে যে কোন মুহূর্তে যে কোন কেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ব্যালট পেপার অথবা বাক্স ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে। স্থানীয় প্রশাসন বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে সাধারণ মানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। প্রশাসনের গুরুত্ব না দেয়ার বিষয়টি নিয়েও নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। বিশেষ দলের প্রার্থীদের ভোটের দিন অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেয়ার জন্যই ঢিলেঢালা নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বলে অনেকেই ধারণা করছে।

জেলার রাজনীতি দু’ভাগে বিভক্ত। সাবেক সরকারী দলের সংসদ সদস্য জয়নাল হাজারীর বিরুদ্ধে হুলিয়া থাকায় তাঁর কর্মী সমর্থকরা কোণঠাসা অবস্থায় রয়েছে। এর বিরূপ প্রভাব জেলার সব কটি আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীদের ওপরই পড়েছে। অন্যদিকে চার দলীয় জোট মনোনীত সদ্য কারামুক্ত প্রার্থী ও তাঁর সদর্থকদের মাঝে চাঙ্গাভাব বিরাজ করছে। এর সুফল পড়ছে তিনটি আসনেই। চাঙ্গাবস্থায় থাকা কর্মী-সমর্থকরা বিভিন্ন গ্রামে বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রতিপক্ষের ভোটারদের ভয় দেখাচ্ছে। হুমকি দিচ্ছে সংখ্যালঘু ভোটারদের। ফলে জেলার সব কটি কেন্দ্রকে অত্যাধিক ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে স্থানীয় প্রশাসন। ঝুঁকির সুযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর আসনে তাঁর নির্বাচনী প্রতিনিধি পুলিশ পাহারায় নির্বাচনী প্রচার কাজ করছেন। একই অবস্থা জেলার অপর দুই আসনেও। এখানেও জোট প্রার্থীরা পুলিশ পাহারায় নির্বাচনী কাজ করছেন। বঞ্চিত হচ্ছে অপর দলের প্রার্থীরা। স্থানীয় প্রশাসন সংখ্যালঘুদের ভোট প্রদান নিশ্চিত করার ব্যাপারেও তেমন জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। দেশের প্রতিটি জেলার মতো এখানেও রাস্তায় সেনা টহলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অথচ এ জেলার সংখ্যালঘুরা ভোটের আগেই একটি দলের সমর্থকদের হুমকির ভয়ে গ্রাম ছেড়েছে। অধিকাংশ গ্রামেই হিন্দু বাড়িগুলোয় তালা ঝুলতে দেখা গেছে। প্রশাসনের
পক্ষ থেকে কোন লোক গিয়ে তাদের মনোবল বাড়ানো বা সাহস যোগানোর মতো কোন কথাও বলেননি বলে জানা গেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংখ্যালঘু পরিবারের এক সদস্য জানান, তাঁর আর্থিক সামর্থ্য
নেই বলে তিনি পড়ে আছেন। যাদের অবস্থা ভাল তাঁদের সবাই ঢাকা, চট্টগ্রাম বা অন্য জেলা শহরে চলে গেছে। তাদের বাড়িগুলোতে তালা ঝুলছে। এ পরিস্থিতিতে তার বা তার পরিবারের সদস্যদের ভোট কেন্দ্রে যাওয়ার কোন ইচ্ছা নেই। তিনি বলেন, ওরা সেনাবাহিনীর গাড়িতে গুলি করে। সেখানে আমাদের কি অবস্থা হবে ভেবে দেখুন।

জেলার তিনটি উপজেলার মধ্যে সোনাগাজী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। শনিবার এখানে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনী পিকআপ নিয়ে আহমেদপুরের ভোরের বাজারে টহল দিচ্ছিল। রাতে একদল সন্ত্রাসী হঠাৎ করে পিকআপ লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করে। এতে কেউ হতাহত হয়নি। এর পর সেনা সদস্যরা সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করলে তারা পালিয়ে যায়। ভোটের একদিন আগে এ ধরনের ঘটনা ঘটলেও প্রশাসন গতানুগতিক নিরাপত্তা অর্থাৎ সেনা ও বিডিআরকে কেন্দ্রের বাইরে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসাবে রেখেই আজকের ভোট গ্রহণের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ১ অক্টোবর ২০০১

কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন

মন্তব্য করুন