চট্টগ্রামের রাউজান রাঙ্গুনিয়া উপজেলার অনেক গ্রামে এবার দুর্গাপূজায় হিন্দুরা ঘটপূজাও করতে পারেনি। ১ অক্টোবর নির্বাচনের পর অনেকের বাড়িঘরে লুটপাট, হামলা, অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সরকার অনুসারী চিহ্নিত সন্ত্রাসী, অনেকগুলো হত্যা, ধর্ষণ মামলার আসামী বিধান-ফজল বাহিনী শত শত সংখ্যালঘু বাড়িঘরে এই তাণ্ডব চালিয়েও ক্ষান্ত হয়নি, ঘটপূজা করতে হলেও চাঁদার ফরমান জারি করে। দুর্গপূজা শেষ। তারা গত শুক্রবার বিজয়া দশমীর দিনে নতুন ফরমান জারি করে বলেছে, দেশে থাকতে হলে অবশ্যই মাসোহারা দিয়ে থাকতে হবে। এমনকি মাসোহারা নির্ধারণ করে গৃহকর্তাদের চিরকুট ধরিয়ে দিয়েছে এই সন্ত্রাসী চক্রটি। পুলিশ প্রশাসনও এই সন্ত্রাসী চক্রে ব্যাপারে টু শব্দটি করতে পারছে না। গত শনিবার রাউজানের কলমপতি গ্রামের অধীর দে (৩০) বিএনপি ক্যাডারদের নতুন ফরমানের প্রতিবাদ করায় পুুরো পরিবারটি ঘরছাড়া হয়ে এখন শহরে আশ্রয় নিয়েছে কেউ কেউ নির্বাচনের পূর্বাপর তাণ্ডবের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেও প্রশাসন বা পুলিশের কোন সহযোগিতা না পেয়ে এখন সবকিছুকে ‘অদৃষ্টের পরিহাস’ হিসেবে মেনে নিচ্ছেন। কয়েকজন অভিযোগ করলেন, ‘পুলিশ সন্ত্রাসী ও তাণ্ডবের নায়কদের গ্রেফতার করতে গিয়ে বিএনপির এক শীর্ষ নেতার রোষানলে পড়ে এখন নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে। পুলিশেরই বা দোষ দিই কী করে? সাংবাদিকদের কাছে বলে লাভ কী? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো বলেছেন, সাংবাদিকরা অতিরঞ্জিত করে লিখছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যের পর এখানে সন্ত্রাসীরা আরও বুক ফুলিয়ে তাণ্ডব চালিয়ে যাচ্ছে। গত শুক্রবার তারা নতুন ফরমানপত্র বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দিয়েছে। এ ফরমানপত্রে তারা বলেছে, দেশে থাকতে হলে মাসিক হারে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা তাদের ফান্ডে চাঁদা দিতে হবে। জমিজমা, গাছপালা বা পুকুরের মাছ বিক্রি করতে চাইলে তাদের অনুমতি নিতে হবে। অন্তত শতাধিক পরিবারের হাতে পৌঁছেছে নতুন এ ফরমান। রাউজানের নোয়াপাড়া, গুজরা, ডাবুয়া, গহিরা, কোয়েপাড়া, বিনাজুরি, চিকদাইর, বাগোয়ান এবং রাঙ্গুনিয়ার কদমতলি, শান্তিনিকেতন, শিলক, সাবেক রাঙ্গুনিয়া, পোমরা, পাদুয়া গ্রামে সংখ্যালঘু নির্যাতন শুরু হয় নির্বাচনের এক সপ্তাহ আগে থেকে। ২৩ সেপ্টেম্বর কোয়েপাড়ায় সুনীল চৌকিদারের দোকানে, দাশপাড়ার ৫টি বাড়িতে এক সঙ্গে আগুন দেয়া হয়। এর ২দিন পর নোয়েপাড়ায় সুবোধ দাশ, চয়ন দাশ, সুভাষ দাশ ও স্কুল শিক্ষিকা অনিতা দাশের বাড়িসহ কমপক্ষে ৪০টি বাড়িতে লুটতরাজ চালানো হয় এবং নির্বিচারে মারধর করা হয় নারী-পুরুষ-শিশুদের। নির্বাচনের আগের দিন রাঙ্গুনিয়ার কদমতলির পল্লী চিকিৎসক গোপাল চন্দ্র শীল, রাউজানের গুজরা ইউনিয়নের চন্দন ঘোষ, কোয়েপাড়ার মীরা দাশের বাড়িতে হামলা চালানো হয়। নির্বাচনের পর রাউজান-রাঙ্গুনিয়ার অন্তত ৪০টি সংখ্যালঘু বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। ১৪ অক্টোবর রাতে রাঙ্গুনিয়ার শান্তিনিকেতনের রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমে নির্মাণাধীন দুর্গা প্রতিমা ভেঙ্গে দেয়া হয়। সর্বশেষ গত শনিবার রাতে চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় রাউজানের নোয়াপাড়ায় সলিল দে নামে এক ব্যবসায়ীকে বেধড়ক পেটানো এবং তার বাড়ি লুট করা হয়। একই রাতে ওই এলাকার বাসিন্দা মনতোষ দাশের পুত্র ধনতোষ দাশের বাড়িতে সন্ত্রাসীরা চাঁদার ফরমান পৌঁছে দেয়। পুলিশের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসব ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে এ প্রতিবেদককে বলেছেন, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজির নায়ক কারা এবং তাদের পৃষ্ঠপোষক কারা তা আমাদের জানা; কিন্তু কিছুই করার নেই। দিনকয়েক আগে তাদের গ্রেফতারের জন্য পুলিশ তৎপর হলেও বিএনপির এক শীর্ষনেতার হস্তক্ষেপে সেই তৎপরতা বন্ধ করতে হয়।

সংবাদ, ৩০ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন