মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ শীর্ষক কনভেনশনে প্রদর্শিত নির্যাতন চিত্র গোটা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটের বাতাস ভারি করে তুলেছিল। নিঃশব্দ কান্না যেন উথলে উঠেছিল। অভূতপূর্ব শৃঙ্খলার মধ্যে অনুষ্ঠিত প্রথম দিনে মিনি পর্দার সামনে বসা দর্শকদের অনেকেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন। নিঃশব্দ নীরবতায় নির্যাতিত নারী-পুরুষের কণ্ঠে অমানবিক নির্যাতনের কাহিনী শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে আকুল-পাগলপারা অনুভূতি সৃষ্টি করেছিল। কনভেনশনের দর্শন ধারণ করে আগত সবাই স্মৃতির মানসপটে ‘মনুষত্ব বোধ’কে সুতীক্ষ্ম করে ধর্ম-বর্ণ-দল-মত নির্বিশেষে মানবতাকে যেন সমুজ্জ্বল করেছিল স্বীয় মুখচ্ছবিতে। এই পাশবিক নির্যাতনচিত্র সরকার আর রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি যে নিদারুণ ঘৃণার সৃষ্টি করেছিল সকলের মুখেই সে কথা ঘুরছিল। সকালের অধিবেশন শেষে বিকালের অধিবেশনের আগে মধ্যাহ্ন বিরতিতে দীর্ঘদিন পর সুধীজনরা বন্ধুজনকে পেয়ে অনেকেই ফিরে গেছেন ’৭১-র স্মৃতিকথায় বলেছেন প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্কটের কথা। সমালোচনা করেছেন আওয়ামী রাজনীতির স্থবিরতারও। কনভেনশনের মূল আকর্ষণ দেশব্যাপী অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনোত্তর পাশবিক নির্যাতনচিত্র ধারণ করে নির্মিত শর্ট ফিল্ম। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনের বাইরে বিশাল প্যাণ্ডেলে মিনি পর্দায় এই শর্ট ফিল্ম প্রদর্শনের ব্যবস্থা পুরো আয়োজনকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে তেমনি দিয়েছে যথার্থ বেগ। সারা দেশ থেকে আগত নির্যাতনের শিকার নারী-পুরুষরা কেউই যেন স্বাভাবিক-সাবলীল ভাষায় বর্ণনা করতে পারেননি ভয়ানক আক্রমণের কথা-কাহিনী। কেউ কথা বলতে গিয়ে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন, আর কেউবা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করেন। নির্যাতিত মানুষের হৃদয়ের ভিতর থেকে উত্থিত এই কান্না যেন পাষণ্ডেরও হৃদয় কেড়েছে। দেশের বিভিন্ন জেলা, থানা এবং গ্রামপর্যায় থেকে আগত নির্যাতিত মানুষের অবস্থানের জন্য তৈরি করা হয়েছিল আলাদা প্যান্ডেল। এই ণ্ডেলের সামনে লাগাতার ভিড় জমে ছিল। নৌকায় ভোট দেয়ার অপরাধে (!) কেউ হয়েছে ধর্ষিত, কারও হাত কেটে নেয়া হয়েছে, কারও পা ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে, কেউবা পরিবার-পরিজন নিয়ে সর্বস্ব হারিয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে এখন উদ্বাস্ত জীবনযাপন করছে। এদের দীর্ঘশ্বাসে ভারি হয়ে উঠেছিল ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন। নির্যাতনচিত্রে দেশের সকল জেলার বর্ণনাতীত অমানুষিক ঘটনার বিষয় তুলে ধরা হয়েছে তবে সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ভোলা, বরিশালের কথা। ন্ডেলের বাউন্ডারি মোড়ানো কাপড়ে নির্যাতিত হিন্দু মহিলাদের সম্ভ্রম হারিয়ে বেঁচে থাকার সকরুণ আর্তনাদের ছবি যেন ধর্মব্যবসায়ীদের প্রতি ঘৃণা আর ধিক্কারের ঝড় তুলেছিল প্রকৃত ইসলামী মূল্যবোধসম্পন্ন মানুষদের মধ্যে। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের গেটে পাঁচ শতাধিক ছবি টানিয়ে ব্যবস্থা ব্যবস্থা করা হয়েছিল নির্যাতনচিত্র প্রদর্শনীর। ব্যাপক দর্শক সমাগমে এই চিত্র প্রদর্শনীও ক্ষণে ক্ষণে আবেগমথিত করেছিল। প্রবেশপথে গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীর মাথায় আঘাতের পর খুলি থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় মগজ বেরিয়ে আসছে দেখে পথচারীরা পর্যন্ত আঁতকে উঠেছেন। সবার হৃদয়ে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়েছে হায়রে মানবতা!

দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০০২

মন্তব্য করুন