পাঁচ বছর আগে গোবিন্দগঞ্জের সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্মের পিতৃপুরুষের ভূমির অধিকার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে মারা যান তিন সাঁওতাল শ্যামল হেমব্রম, মঙ্গল মার্ডি ও রমেশ টুডু। এই হত্যা মামলার চার্জশিট দুইদফায় দেওয়া হলেও বাদ দেওয়া হয়েছে মূল ১১ আসামিকে। তাই বাদীকে বাধ্য হয়েই করতে হয় নারাজির আবেদন। এ অবস্থার মধ্যেই তাদের জন্য মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই বাগদাফার্মের জমিতে সরকারের নতুন করে ইপিজেড করার সিদ্ধান্ত।

তিন হত্যার উপযুক্ত বিচার এবং বাগদাফার্মের জমিতে ইপিজেড করার সিদ্ধান্ত বাতিলের দাবিতে সেই বাগদাফার্মের মাঠেই শনিবার সমাবেশ করেছে সাহেবগঞ্জের বাগদাফার্ম এলাকার ভূমি নিয়ে লড়াই করা জনগোষ্ঠী। সমাবেশটি আয়োজন করে সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী বাঙালি সংহতি পরিষদ, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম, এএলআরডি, সিডিএ ও কাপেং ফাউন্ডেশন।

হত্যার পাঁচ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজন করা এ সমাবেশে সকাল থেকেই বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসতে থাকেন সাঁওতালসহ নানা আদিবাসীরা। বাগদাফার্ম এলাকায় বসবাসকারী বাঙালি-আদিবাসীরা আসে মৌন মিছিল করেন। তীর-ধনুক আর বর্শা নিয়ে তারা প্রতিবাদ জানাতে আসেন এত বছর ধরে চলে আসা অন্যায়ের। হাতে লাল-সবুজের জাতীয় পতাকা, মুখে তাদের স্লোগান ‘শ্যামল-রমেশের রক্ত বৃথা যেতে দেব না’ আর ‘রক্তভেজা জমিতে ইপিজেড হবে না’। সমাবেশ শুরু হওয়ার আগেই প্যান্ডেল ভরে যায় সাঁওতাল বাঙালিদের মিলনমেলায়।

ভিড়ের মধ্যেই অনেক কষ্টে খুঁজে পাওয়া যায় ফিলিমন বাস্কেকে। তিনি সাহেবগঞ্জ বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সভাপতি। মূলত তিনিই এ আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কথোপকথনের সময় জমির ইতিহাস তুলে ধরে ফিলিমন বলেন, ১৯৫৪ সালে আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে বাগদাফার্মের ১৮৪২ দশমিক ৩০ একর জমি আখ চাষের জন্য অধিগ্রহণ করে নেয়। অধিগ্রহণ চুক্তির সাতটি শর্তের একটি ছিল, যদি চিনিকল বন্ধ হয়ে যায়, তাহলে চিনি শিল্প করপোরেশন সরকারের মাধ্যমে জমি আমাদের কাছে ফিরিয়ে দেবে। সে শর্ত অনুযায়ী, ২০০৪ সালে চিনিকল বন্ধ হয়ে গেলে আমাদের জমি ফেরত পাওয়ার কথা। কিন্তু আমরা আজও জমি বুঝে পাইনি।

ফিলিমন বলেন, ২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর এই জমির অধিকার নিয়ে তিন সাঁওতাল ভাই জীবন দেন। আমাদের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয় পুলিশ ও চিনিকল কর্তৃপক্ষ। হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পার হলেও আমরা এর কোনো বিচার পাইনি। এখন আমাদের এই জমিতে ইপিজেড করতে চাচ্ছে সরকার। যত কিছুই হোক, আমরা আমাদের বাপ-দাদার জমি ছাড়ব না। এখানে ইপিজেড হবে না।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, পাঁচ বছর আগে আমার বন্ধুদের হত্যা করা হয়েছে। কারণ তারা তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি চেয়েছিল। আজও তাদের বিচার হয়নি। একটা জাতি যখন হত্যাকাণ্ডের বিচার করতে পারে না, সেই কলঙ্কটা জাতির গায়ে লাগে। রাষ্ট্র যদি এই বিচার না করে, তাহলে এই কলঙ্কের ভার তাদের। আমরা বারবার তাদের মনে করিয়ে দেব, তারা তাদের দায়িত্ব পালন করেনি। আমরা দেখতে চাই, আমাদের বন্ধুদের হত্যার বিচার হয়েছে।

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী অনেকবার বলেছেন তিন ফসলি জমিতে শিল্পকারখানা হবে না। কিন্তু বাগদাফার্মের তিন ফসলি জমিতেই ইপিজেড করার চিন্তা করা হচ্ছে। তার প্রশ্ন, শিল্পকারখানা করার ক্ষেত্রে সব ছেড়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জমির ওপর কেন বারবার নজর পড়ে?

সুলতানা কামাল বলেন, পলাশবাড়ি উপজেলার সাকোয়া এলাকার জনগণ তাদের এলাকায় ইপিজেড করার জন্য আবেদন করেছে। আমি বুঝতে পারি না, ওই জমি ছেড়ে কেন এখানেই ইপিজেড করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, আমরা একটি ন্যায্য দাবির পক্ষে আজকে এই মঞ্চে দাঁড়িয়েছি, আমাদের দাবিগুলো তুলে ধরতে হবে। আমাদের বক্তব্যগুলো নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। যতদিন এ হত্যার বিচার হবে না , আমরা এই আন্দোলন থেকে সরব না। আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাব।

আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদের আহ্বায়ক সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, এই জমি কখনোই চিনিকলের ছিল না। সাতটি শর্তে জমিগুলো অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। তারা শর্ত ভঙ্গ করার কারণে বর্তমানে আদিবাসী-বাঙালিরাই এই জমির মালিক। আমরা এই জমি উদ্ধারে আদিবাসী বাঙালি একসঙ্গে ছিলাম এবং এই জমি উদ্ধার না হওয়া পর্যন্ত আইনি সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।

বেসরকারি সংগঠন এএলআরডির নির্বাহী পরিচালক শামসুল হুদা বলেন, আপনারা বছরের পর বছর ধরে কষ্ট করছেন, খেয়ে না খেয়ে থাকছেন। কনটোরেশনের যারা কর্মকর্তা, আপনাদের অনেকের আমলনামা আমাদের কাছে আছে। ২০০৩ সালে চিনিকল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর রাষ্ট্র কী ক্ষতির শিকার হয়েছে, সেটি আমরা তুলে ধরব। প্রয়োজন হলে গণতদন্ত কমিটি করব। আমরা যেমন জমি ছাড়ব না, তেমনি অন্যায়-দুর্নীতির প্রতিবাদ আর লড়াই করে যাব।

এছাড়াও সমাবেশে বক্তব্য দেন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক সুবিন চন্দ্র মুন্ডা, সিডিএর পরিচালক শাহ-ই-মুবিন জিন্নাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রোবায়েত ফেরদৌস, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাংগঠনিক সম্পাদক হরেন্দ্রনাথ সিং এবং তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক দীপায়ন খীসা, প্রাণ ও প্রকৃতি গবেষক পাভেল পার্থ, নাগরিক উদ্যোগের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন, জাতীয় আদিবাসী পরিষদের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক মানিক সরেন, কাপেং ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক খোকন সুইটেন মুরমু প্রমুখ।

সমকাল

মন্তব্য করুন