সংখ্যালঘুদের ভোটদানে বাধা সৃষ্টির ব্যাপারে যা আশঙ্কা করা হয়েছিল বহু স্থানে তাই ঘটেছে। ব্যাপক ভয়ভীতি-সন্ত্রাস ছড়িয়ে তাদেরকে নানাভাবে ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখার অপচেষ্টা চালিয়েছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তি। তাদের সঙ্গে জুটেছিল জাতীয়তাবাদী নামধারী দলটিও। পিরোজপুরে জামায়াতীদের হাতে আহত হয়েছে ৩৩ জন। বরিশালের চারটি আসনের বেশীর ভাগ কেন্দ্রে প্রকাশ্যেই বাধা দেওয়া হয়েছে সংখ্যালঘুদের। ফেনীতে সংখ্যালঘু এক যুবতী ধর্ষিত হয়েছে। ভোট দিতে বাধা দেওয়া ছাড়াও ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সংখ্যালঘু কর্মকর্তাদেরও নির্বাচনের দিন হয়রানির খবর পাওয়া গেছে।

সংখ্যালঘুদের ভোটার তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার গোপন ষড়যন্ত্রের কথা জানা গেছে। ভোটার না করার অপচেষ্টার শিকার হয়েছেন দেশের বিশিষ্ট ব্যাক্তিসহ অনেকে। উদ্দেশ্যমূলক ভাবে ভোটার তালিকা থেকে তাদেরকে বাদ দেয়ার বিষয়টি ভোট দিতে গিয়ে জানা গেছে।নির্বাচনের আগে ব্যাপকভাবে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, বোমাবাজি, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ নানা ভয়ভীতি প্রদর্শনের নিরিখে দেশের পৌনে এক কোটি সংখ্যালঘু ভোটারের মধ্যে বিপুলসংখ্যক ভোট দিতে পারবেন না বলে পর্যবেক্ষকরা ধারণা করেছিলেন। পিরোজপুর সদর উপজেলার ৭২টি কেন্দ্রের ৪০টিতে কুখ্যাত রাজাকার দিইল্যা ওরফে জামায়াতী দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘুদের উপর বার বার হামলা চালিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করে ভোট দিতে দেয়নি। উমেদপুর, দূর্গাপুর, টোনা, ডাকাতিয়া, হুলারহাটে জামায়াতী সন্ত্রাসীদের হাতে ৩৩ জন সংখ্যালঘু আহত হয়েছে। উমেদপুরে স্বপ্না নামের একজন ভোটারকে মারধর করে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হয়।

বরিশালের ভুরঘাটা কেন্দ্রেও ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ কেন্দ্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটাররা যাতে কেন্দ্রে না যেতে পারেন সেজন্য সকালেই বিএনপির কর্মীরা বিবাদ বাঁধিয়ে দিয়ে ব্যালট পেপার লুট করে নিয়ে যায়। উদ্ধারকৃত একটি বই সেনা সদস্যদের কাছে জমা দেয়া হয়েছে। ফেনীর তিনটি আসনের ৩০টি কেন্দ্রে সংখ্যালঘুদের ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। সারা দিন তাদেরকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। রবিবার গভীর রাতে সংখ্যালঘু অধ্যুষিত একটি গ্রামে হামলা চালিয়ে তাদের ভিটে ছাড়া করা হয়। শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দলের নেতা ও বিশিষ্ট সাংবাদিক নির্মল সেনই ভোটার হতে
পারেননি! তাঁর মত খোদ রাজধানীতেই সংখ্যালঘু অনেকেই ভোটার হতে পারেননি।

মুগদাপাড়ায় এক সাংবাদিক পরিবারের সদস্যদের নাম-ধাম লিখে নিয়ে তাদেরও আর ভোটার করেনি। শ্যামপুরে একটি পরিবারের সদস্যদের নাম ধাম লিখে পরে একটি স্লিপ দিলেও ভোটার তালিকায় তাদের নাম ওঠেনি। ভোট দিতে গিয়ে তারা জানতে পারেন যে তাদের নাম তালিকায় নেই। প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার হিসাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার পরও ভোটের দিন অনেক সংখ্যালঘু অফিসারকে দায়িত্ব পালন করতে দেয়া হয়নি বলে জানা গেছে। রাজধানীতেও মানিকনগরের একটি ভোট কেন্দ্রে এ ধরনের একটি ঘটনা জানা গেছে। মডেল হাই স্কুলের পোলিং অফিসার হিসাবে বঙ্গভবন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রবীন্দ্রনাথ রায় গতকাল দায়িত্ব পালন করতে গেলে তাঁকে জানানো হয় যে,তাঁকে পোলিং অফিসারের দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। প্রশিক্ষণ দিয়ে একজন শিক্ষককে তাঁর
অগোচরে বাদ দেওয়ার কোন ব্যাখ্যা কেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার দিতে পারেননি। সাতক্ষীরার তালা ও শ্যামনগরের ৪টি কেন্দ্রে সংখ্যালঘুদের ভোট দানে বাধা দেয়া হয়েছে। সকাল ১১টা পর্যন্ত ধানদিয়া উত্তর সারসা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আলীপুর কেন্দ্রে মহিলাদের বুথে ঢুকে ভোটদানে বাধা দেয়ায় হাজী নাজিমউদ্দিন নামে এক জামায়াত নেতাকে সেনা সদস্যরা গ্রেফতার করে।

পাবনার সুজানগরে মানিকদিয়ার গ্রামে সংখ্যালঘুদের ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে সেনা ও পুলিশ সদস্যরা ছাত্রদল নেতা ফজলুর রহমান ফজলুকে গ্রেফতার করে। পটুয়াখালির কলাপাড়ায়
৪টি কেন্দ্রে বহু সংখ্যালঘুর ভোট আগেই দেয়া হয়ে যায় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। নৌসেনাদের উপস্থিতিতে নির্ভয় পেয়ে মংলায় সংখ্যালঘুদের মধ্যে অনেকে ভোট দিতে যান। তবুও ভোট কেন্দ্রে তাঁদের উপস্থিতি ছিল কম। হবিগঞ্জ থেকেও সংখ্যালঘুদের ভোটদানে বাধার খবর পাওয়া গেছে। সদর থানার নোয়াগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে কিছু সংখ্যালঘু সেনা সদস্যদের সহায়তায় ভোট দিতে সক্ষম হন। রাজশাহীর তানোর-গোদাগাড়ি আসনে আদিবাসিরা হুমকির মুখে ভোট দিতে পারেননি। তবে সেনা সদস্যদের সহযোগিতায় তাঁদের একটি অংশ ভোট দিতে পেরেছেন।

ঠাকুরগাঁও-১ আসনে সংখ্যালঘুদের অনেকের বাড়িতে হামলা হয়েছে। অনেক কেন্দ্রে তাদেরকে ভোট দানে বাধা দেয়া হয়েছে। পুরনো ঠাকুরগাঁও হাইস্কুল কেন্দ্রে জানানো হয় যে তাদের ভোট দেয়া হয়ে গেছে।
সিলেট শহরের শিববাড়ির পথ্যপাড়াতে রবিবার গভীররাতে ১৫টি সংখ্যালঘু পরিবারের ঘরে তালা লাগিয়ে আসা হয়। সকালে তালা ভেঙ্গে তাদের বের করে আনা হয় ও এলাকার প্রায় ৭০০ ভোটার প্রতিবাদ মিছিল করে ভোট দিতে আসেন। চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় ৪০ হাজার সংখ্যালঘু ভোট দিতে পারেনি জামায়াত-বিএনপি সন্ত্রাসীদের বাধায়।

দৈনিক জনকন্ঠ, ২ অক্টোবর ২০০১

কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন

মন্তব্য করুন