পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় আদিকাল ধরে বসবাস করে আসা রাখাইন আদিবাসীরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। যেসব পর্যটক কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে যান, তাদের কাছে রাখাইনদের বৌদ্ধ বিহারগুলো আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে। এমন একটি জনপদে নতুন প্রজন্মের শিশুরা বেড়ে উঠছে আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় শিক্ষার অধ্যয়ন ছাড়াই। সেখানকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মশিক্ষার বই ও ধর্ম শিক্ষকের অভাব থাকায় তাদের বাধ্য হয়ে ইসলাম বা খ্রিস্টান ধর্মের পাঠ্যবইগুলো পড়ে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হচ্ছে। রাখাইনদের একটি অংশ বৌদ্ধ ধর্মের পুরোনো পাঠ্যবই ফটোকপি করে কোনোরকমে পড়াশোনা করে যাচ্ছে বলেও জানা গেছে। তবে এই অংশটি খুবই নগন্য। যেখানে দিন দিন আদিবাসীদের নিজস্ব মাতৃভাষায় শিক্ষা প্রদানের দাবি জোরালো হচ্ছে, সেখানে রাখাইন শিশুরা নিজ ধর্মের পাঠ্যবই পাচ্ছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে। শুধু কুয়াকাটাই নয়, এরকম পরিস্থিতি আদিবাসী রাখাইন অধ্যুষিত পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলার বেশিরভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।
কুয়াকাটার গোড়াআমখোলা পাড়ার তেননান রাখাইনের মেয়ে জেমাসো রাখাইন পড়াশোনা করছে ১১৭ নম্বর আমজেদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। জেমাসো ছাড়াও একই শ্রেণিতে আছে মম রাখাইন ও জেরি রাখাইনের মতো শিক্ষার্থীরা। স্কুলটিতে ধর্মীয় পাঠ্যবই হিসেবে তাদের বৌদ্ধ ধর্ম পড়ার সুযোগ নেই। তাই বাধ্য হয়ে তাদের ইসলাম ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার বই পড়তে হচ্ছে। চলতি বছর প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায়ও ইসলাম শিক্ষা বিষয়েই পরীক্ষা দেবে তারা। একই পরিস্থিতির মধ্যে আছে ওই পল্লির মহিপুর কো-অপারেটিভ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী উসেচান ও লুংসোমং। এর কারণ হিসেবে স্কুল কর্তৃপক্ষ শিক্ষক ও বৌদ্ধ ধর্মের পাঠ্যবই সংকটকেই দেখাচ্ছে প্রধান কারণ হিসেবে। ১১৭ নম্বর আমজেদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আক্তারুন্নেছা জেলি বলেন, আমাদের এখানে দুটি আদিবাসী রাখাইন পল্লির ১০-১২ শিক্ষার্থী আছে। বৌদ্ধ ধর্ম পড়ানোর মতো প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই। ওই ধর্মের শিক্ষার্থীরা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম ও অন্য বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করছে। একই বক্তব্য পাওয়া গেছে মহিপুর কো-অপারেটিভ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সালামের কাছে থেকে।
এদিকে কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আবুল বাশারের দাবি, শিক্ষার্থীরা ‘স্বতঃপ্রণোদিত’ হয়ে অন্য ধর্মের বই পড়ছে।
স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অন্য ধর্মের বই পড়লে এর দায় শিক্ষা অফিসের থাকে না। তবে তিনি বাংলা ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মের পাঠ্যবই থাকলেও বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের স্বল্পতায় রাখাইনরা ধর্মীয় শিক্ষায় পিছিয়ে আছে বলে স্বীকার করেন। অবশ্য কিছু ব্যতিক্রমও আছে। পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী মেলিছান ও চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সানলেন বৌদ্ধ ধর্মের বই পড়েই পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে। এক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষ নয়, তাদের পরিবারের সচেতনতার কারণেই এ সুযোগ পাচ্ছে তারা। ওই দুই শিক্ষার্থীর অভিভাবকরা বৌদ্ধ ধর্মের পুরোনো বই ফটোকপি করে সংগ্রহ করেছেন। পরিবারের সদস্য এতেন রাখাইন বইটি পড়তে তাদের সহযোগিতা করছেন।
আবার সরকারি স্কুলগুলোর কোনো কোনোটি বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষক রেখে শিক্ষার্থীদের পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে। এমনই একটি স্কুল ৬০ নম্বর লতাচাপলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক নজরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, আমার স্কুলে ১০ থেকে ১২ জনের মতো রাখাইন শিক্ষার্থী আছে। এখানে বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষক আছেন। এনসিটিবি থেকে বৌদ্ধ ধর্মের পাঠ্যবই পাওয়ায় শিক্ষাদানে আমাদের এখানে কোনো সংকট নেই।
সংস্কৃতিকর্মী চোতেন রাখাইন বলেন, স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে আমাদের এখানে নিজস্ব ভাষায় বৌদ্ধ ধর্মের বই নেই। বেশিরভাগ জায়গায় শিক্ষকও নেই। অন্য ধর্মের বই পড়েই তাদের পরীক্ষায় পাস করতে হয়। ধর্মীয় শিক্ষা ও নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতি থেকে রাখাইন শিক্ষার্থীরা পিছিয়ে আছে উল্লেখ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কারিতাসের রাখাইন আইসিডিপি প্রকল্পের বরিশাল জোন ইনচার্জ মংমিয়্যা বলেন, নতুন প্রজন্মের রাখাইনরা নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে পাড়লেও লিখতে বা পড়তে পারে না। রাখাইন আইসিডিপি প্রকল্প বৌদ্ধ বিহারকেন্দ্রিক রাখাইন শিক্ষার্থীদের জন্য মাতৃভাষা চর্চাকেন্দ্র চালু করলেও তহবিলের অভাবে এটি এখন বন্ধ আছে।
প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) আবুল বাশার জানান, রাখাইনদের মাতৃভাষায় বৌদ্ধ ধর্মের বই প্রকাশের জন্য সংশ্নিষ্ট দপ্তরকে লিখিতভাবে অবহিত করা হয়েছে।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড বাংলাদেশের (এনসিটিবি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক নারায়ণ চন্দ্র সাহা সমকালকে বলেন, সরকারি নির্দেশনা পেলে কারিকুলাম প্রণয়ন করে আদিবাসী রাখাইনদের মাতৃভাষায় বৌদ্ধ ধর্মের বই প্রকাশ করব। পার্বত্য জেলার পাঁচটি ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষায় বই প্রকাশ করছে এনসিটিবি।