হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার আর মাত্র চারদিন বাকি। অথচ বাগেরহাটের সংখ্যালঘু গ্রাম গুলোতে এবার উৎসবের আমেজ নেই। নেই পূজার কোন প্রস্তুতি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতা এবার পূজার সব অয়োজনকে মাঝপথে ভণ্ডুল করে দিয়েছে। এ জেলার তিন লক্ষাধিক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর পূজার আনন্দ বিষাদে পরিণত হয়েছে। সন্ত্রাসীদের হামলা আর নির্যাতনে এ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বিচ্ছিন্ন হিন্দু পরিবার গুলোতে এখন শুধু দীর্ঘশ্বাস আর হাহাকার বিরাজ করছে। গত কয়েক দিন ধরে বাগেরহাটের বিভিন্ন উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রাম গুলো ঘুরে জানা যায়, অন্যান্য বারের মতো এবারও হিন্দু সংখ্যালঘু গ্রাম গুলোতে ঘটা করে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার, নির্যাতন শুরু হওয়ায় সব আয়োজনই ভণ্ডুল হয়ে গেছে। বিএনপি ও জামায়াতের ক্যাডার নামধারী হিংস্র শ্বাপদেরা শুধু সংখ্যালঘু পরিবার গুলোর ওপর হামলা চালায়নি, তাদের মন্দির, পূজার আয়োজনের ওপরও আঘাত হানে। ভেঙ্গে ফেলে নির্মীয়মান প্রতিমা। মারধর করে তাড়িয়ে দেয় প্রতিমা তৈরিরত শিল্পীদের। নির্যাতন-হামলায় গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ হিন্দু পরিবারের সদস্যরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে পূজার উৎসব করার মত আনন্দ হারিয়ে যায় সংখ্যালঘু পরিবারগুলো থেকে। জনকন্ঠ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে সংখ্যালঘু পরিবারের প্রবীণ সদস্যরা বলেন, ঢাকায় কেন্দ্রীয় নেতৃত্ববৃন্দ এবার অনাড়ম্বর পূজার সিদ্ধান্ত নিলেও আমাদের গ্রাম গুলোতে পূজা হবে না। আত্মীয়পরিজন ছাড়া আমরা পূজা করব কি করে? দুর্গাপূজার প্রধান ধরনটি বারোয়ারী হওয়ায় ধনী-গরিব নির্বিশেষে পূজা আয়োজনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। একে অন্যের সহযোগিতার মাধ্যমে পূজা অনুষ্ঠানের সার্বিক ব্যবস্থাপনা সম্পন্ন হয়। বাগেরহাট জেলায় প্রতিবছর চার শতাধিক মণ্ডপে পূজা হয়ে থাকে। আগামী ২২ অক্টোবর থেকে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সর্ববৃহৎ এই ধর্মীয় উৎসবের ৫ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান শুরু। মাঝখানে মাত্র চারটি দিন থাকলেও গোটা জেলায় ক্ষোভ, হতাশা, ছড়িয়ে আছে। তারা নিজেরাও জানে না কিভাবে, কেমনভাবে পূজা হবে। জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতাদের মধ্যে নানারকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব আছে। সোমবার সন্ধ্যায়ও বাগেরহাট জেলা পূজা উদ্যাপন পরিষদ নেতারা বৈঠকে বসেছিলেন। সেখানকার প্রতিনিধিরা তিনটি সম্ভাবনা নিয়ে অলোচনা করেছেন। এক, কেন্দ্রীয় পূজা উদ্যাপন পরিষদের সিদ্ধান্ত মতে অনাড়ম্বরভাবে পূজার আয়োজন করা। দুই আড়ম্বরের সঙ্গে পূজার আয়োজন করা এবং তিন পূজা অনুষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা। গত সপ্তাহজুড়ে বাগেরহাট জেলার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত প্রত্যন্ত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গ্রাম থেকে যাওয়া মানুষ গুলোর সঙ্গে কথা বলে পূজা সম্পর্কে তেমন কোন উৎসাহ দেখা যায়নি। জেলা শহর ও থানা শহরগুলোয় পূজা হবে। তবে গ্রামে পূজা অনুষ্ঠানের স্বতঃস্ফূর্ততা নেই। হামলা, লুটপাট, ভাংচুর, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ প্রভৃতির মতো অমানবিক আক্রমণে সংখ্যালঘু মানুষ গুলোর মনোবল ভেঙ্গে গেছে। অজানা আতঙ্কে তারা সন্ত্রস্ত চিতলমারীর খাসেরহাটে লুকিয়ে থাকা মনোরঞ্জন দাস বলেন, তার মেয়ে এক আত্মীয় বাড়িতে। স্ত্রী অন্য এক জায়গায়, তিনি আর এক জায়গায় পূজার আনন্দ কি করে হবে। পরিবারের সকল সদস্য এক জায়গায় হতে পারার ব্যাপারেও তিনি সন্দেহ পোষণ করেন। ভীতি আর আতঙ্ক যেখানে আমাদের পিছু তাড়া করছে, সেখানে কিসের পূজা? ঝাঁঝালো কন্ঠে তিনিই পাল্টা প্রশ্ন করেন। রামপালের গিলাতলা প্রাচীন ঐতিহ্যসমৃদ্ধ এলাকা। এখানেও বেশ জাঁকজমকের সঙ্গে পূজা হয়ে থাকে। এবারে কেমন হবে সে ব্যাপারে কেউ কোন কথা বলতে পারলো না। তার ওপর আছে প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা। মোড়েলগঞ্জের হেড়মায় প্রতিমা ভাংচুর হয়েছে। এছাড়া চিতলমারী ও রামপালে প্রতিমা ভাংচুরের কথা শোনা গেছে।

দৈনিক জনকন্ঠ, ১৭ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন