হযরত খান জাহান আলীর (রঃ) পুন্যভূমি বাগেরহাটের ধর্মীয় সংখ্যালঘু গ্রামগুলো এখন সন্ত্রত্র জনপদ। নৌকায় ভোট দেয়ার অপরাধে এসব গ্রাম এখন বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলছে। ক্রমাগত হামলাও হুমকি-ধমকিতে চরম আতংকের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে এসব গ্রামের হিন্দু পরিবার গুলো। প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে সংখ্যালঘু পরিবারের হাজার হাজার নারী-পুরুষ। বুধবার বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগের সমর্থকদের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতনের কাহিনী জানা গেছে। নির্বাচনের আগে এ জেলার সংখ্যালঘু গ্রাম গুলোতে হুমকি-ধমকি চলেছে। আর নির্বাচনের পর এখন চলছে নানা ধরনের অত্যাচার। হিন্দু অধ্যুষিত গ্রামগুলো বহিরাগত ক্যাডারদের সশস্ত্র হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের শিকার হচ্ছে। আর যেসব গ্রামে হিন্দু-মুসলমানরা যৌথভাবে বসবাস করছে, সেসব গ্রামের সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর অবস্থা আরো শোচনীয়। প্রতিনিয়ত সন্ত্রাসীদের চোখ রাঙানো আর নির্যাতনে প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে দিনাতিপাত করছে তারা। বাগেরহাটের সার্বিক অবস্থা এমন যে, গ্রাম গুলোতে হিন্দু পরিবার গুলো অবরুদ্ধ হয়ে আছে। সন্ত্রাসীদের অত্যাচারের মাত্রা এমন ভয়াবহ যে, প্রতিবেশী মুসলমান পরিবারগুলোও তাদের রক্ষার ব্যাপারে অসহায় হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে আরো জানা যায়, নির্বাচনের পর নৌকার সমর্থকদের তালিকা তৈরি করে সেই তালিকা ধরে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সশস্ত্র ক্যাডাররা হামলা চালাচ্ছে। এই হামলার শিকার হয়ে গ্রাম গুলোর যুবকরা সব বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছে। ছেলেদের না পেয়ে হিন্দু পরিবার গুলোর মেয়েদের উপর তারা আক্রোশ মিটাচ্ছে। প্রতিহিংসাকারীদের ধর্ষণের শিকার হচ্ছে সংখ্যালঘু মেয়েরা । মোল্লাহাটের গাওলায় মা-মেয়ে একই সঙ্গে ধর্ষিত হয়েছে। ধর্ষণ আর অত্যাচারের ভয়ে কোন গ্রামেই ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মেয়েরা ঘরে নেই। তাদের অন্যত্র সরিয়ে রাখা হয়েছে। পথে পথে লাঞ্ছিত করার কারনে স্কুল-কলেজগামী মেয়েদের স্কুল-কলেজে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। শুধু হিন্দু ছাত্রছাত্রীরাই নয়, সংখ ̈ালঘু শিক্ষকরাও এই সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এ জেলার কোন ̄‹ুল কলেজেই এখন হিন্দু শিক্ষকরা যেতে পারছেন না। বরং প্রাণভয়ে বিভিন্ন এলাকায় পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। চিতলমারী উপজেলার শেষ সীমানা ছুঁয়ে বয়ে গেছে বলেশ্বর নদী। ওপারে নাজিরপুর। সেখান থেকে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোটের উন্মত্ত কর্মী-সমর্থকরা আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকদের ওপর হামলা করছে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামগুলো তাদের প্রধান টার্গেট। আশেপাশের দশ গ্রামের তাড়া খাওয়া মানুষ গুলো এখন নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করছে। অনেকেই আশ্রয় নিয়েছেন চিতলমারীর শেষপ্রান্ত খাসেরহাট ও অশোকনগর এলাকায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালে খাসেরহাট এলাকায় পাকি সেনারাও গিয়ে সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু এবারের নির্বাচনোত্তর জোটকর্মীদের উন্মত্ততায় তারা হতবাক। তারা ক্রমাগত হুমকি দিয়ে চিঠি দিচ্ছে। লাশ চায়। সংখ্যালঘুদের দেশ ছাড়া করা হবে। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা হবে। কোন সংখ্যালঘু নেতা জীবিত থাকতে পারবে না। দুর্বৃত্তরা এও বলে শাসিয়েছে যে, ‘বড়ালের লাশ পেয়েছিলি এবারে লাশও পাবি না।’ তারা চরবানিয়ারী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অশোক বড়াল ও চিতলমারী উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পীযুষ কান্তি রায়কে হত্যা করতে চায়। ১ অক্টোবরের নির্বাচনের আগে থেকেই এই এলাকায় জোটকর্মীরা তাণ্ডব শুরু করে। নির্বাচনের জয় লাভের খবর শোনার পর থেকেই তাদের তাণ্ডবের মাত্রা বাড়তে থাকে। থেমে থেমে খুঁজে খুঁজে সংখ্যালঘু হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে হামলা, ভাংচুর, লুটপাট ও মেয়েদের শালীনতাহানির ঘটনা ঘটেছে। ধর্ষণের ঘটনাও ঘটেছে। যুবক ছেলেদের নির্বিচারে পেটানো হচ্ছে। মেয়েদের পিতামাতার সামনেই অত্যাচার করা হচ্ছে। নারকীয় এ যন্ত্রনা থেকে রেহাই পেতে যাদের সামর্থ্য আছে তারা মেয়েদের দূরে কোথাও পাঠিয়ে দিয়েছে। ছেলেরা পালিয়েছে। যারা খাসেরহাট, অশোকনগর প্রভৃতি এলাকায় আশ্রয় নিয়েছে তারা এখনচারিদিক থেকে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। চারপাশের গ্রাম গুলো জোটের উন্মত্ত সমর্থকদের নিয়ন্ত্রণে। বাঁশবাড়িয়া গ্রামটি এখন যুবক-যুবতি শূন্য। বয়স্ক কিছু মানুষ তাদের ভিটেমাটি আঁকড়ে ধরে আছে। দিনের বেলায় দু’চারজন খুবই চুপিসারে গিয়ে আবারও চলে আসে। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে গোটা এলাকা হয়ে ওঠে ভয়াল ভূতুড়ে জনপদ। সেখানে উন্মত্ত জোট সমর্থকরা তাণ্ডব চালায়। এদের হাতে বাঁশবাড়িয়ার শিশির মণ্ডল বেদম পিটুনির শিকার হয়েছেন। হাতুড়ি দিয়ে শিশিরের সারা শরীরে আঘাতে আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। দশাসই চেহারার এ যুবকটিকে বিশজনের মতো উন্মত্ত জোটকর্মী প্রায় আধা কিলোমিটার রাস্তা ধরে পিটাতে পিটাতে নিয়ে আসে। তার মায়ের আর্তনাদ ও কাকুতি-মিনতিতে একপর্যায়ে স্থানীয় জোট নেতাদের মন গলে। তারা শিশিরকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলে। পিঠমোড়া দিয়ে বাঁধা ক্ষত-বিক্ষত শিশিরকে ধাক্কা দিয়ে খালের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়। তাকে উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে তাকে রাখা যায়নি। চিতলমারীতে ধুয়া তোলা হয়েছে ‘সে নাকি মুসলমানদের দাড়ির অবমাননা করেছে।’ দলে দলে উন্মত্ত মানুষের দল কেন্দ্রে গিয়ে ভয়-ভীতি দেখাতে থাকলে তাকে নিয়ে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। তার চিকিৎসাও হচ্ছে না। বাঁশবাড়িয়াসহ কচুরিয়া, আন্ধারমানিক, সন্তোষপুর, নাছিরপুর, বানিয়ারী, খড়মখানা, ব্রহ্মগাতি, দুর্গাপুর, শ্যামপাড়া প্রভৃতি গ্রামের একই দশা।

দৈনিক জনকন্ঠ, ১১ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন