অবশেষে ডেমরায় আট বছরের শিশু মনির হোসেনকে হত্যার পর লাশ বস্তায় ভরে ফেলে দেয়ার চাঞ্চল্যকর রহস্য উদ্ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। মাত্র তিন লাখ টাকার জন্য শিশু মনিরকে নির্মম নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়। আর তিন লাখ টাকার জন্য মনিরেরই শিক্ষক নূর-ই মদিনা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ হত্যাকাণ্ডটি ঘটায়। হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতা করে তার দুই ছাত্র। পুলিশ ওই অধ্যক্ষ ও দুই মাদ্রাসা ছাত্রকে গ্রেফতার করেছে। গ্রেফতারকৃতরা জিজ্ঞাসাবাদে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছে। শিক্ষকের হাতে ছাত্র খুনের ঘটনায় পুরো এলাকায় তোলপাড় চলছে। স্থানীয়রা তাদের সন্তানকে আর ওই মাদ্রাসায় পড়াবেন না বলে জানিয়েছেন।
ডিএমপির মিডিয়া বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার ওবায়দুর রহমান জানান, গত ৮ এপ্রিল বিকেল পাঁচটার দিকে ডেমরা থানাধীন মসজিদুল-ই-আয়েশা জামে মসজিদের দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় তলায় উঠার সিঁড়ির চৌকিতে সিমেন্টের বস্তার ভেতর থেকে রশি দিয়ে পেঁচানো অবস্থায় শিশু মনিরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। মসজিদের ভেতর থেকে শিশুর লাশ উদ্ধারের ঘটনা ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। মনির স্থানীয় নূর-ই-মদিনা মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ছিল। এ ঘটনায় মনিরের পিতা সাইদুর রহমান বাদী হয়ে ডেমরা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেফতারে ডেমরা জোনের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ কমিশনার রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে সাঁড়াশি অভিযান চলতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ৯ এপ্রিল রাতে হত্যাকা-ে জড়িত থাকায় নূর-ই- মদিনা মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আবদুল জলিল হাদী ওরফে হাদিউজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। তার দেয়া তথ্য মোতাবেক হত্যাকা-ে সহযোগিতা করায় তারই মাদ্রাসার দুই ছাত্র মোহাম্মদ তোহা ও আকরাম হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়।
বুধবার ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ওয়ারী বিভাগের পুলিশের উপকমিশনার ফরিদ উদ্দিন শিশু মনির হত্যার আদ্যোপান্ত রহস্য বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, নিহত আট বছর বয়সী শিশু মনির হোসেনের পিতার নাম সাইদুর রহমান। তিনি পরিবার নিয়ে ডেমরা থানাধীন ডগাইর নতুন পাড়ায় বসবাস করেন। মনিরের বড় দুই বোন হচ্ছে ফাতেমা আক্তার (১২) ও মুন্নি আক্তার (৯)। মনির সবার ছোট ছিল। মনির ডগাইর নতুনপাড়ার নূর-ই মদিনা মাদ্রাসার প্রথম শ্রেণীর ছাত্র ছিল।
অন্যদিনের মতো গত ৭ এপ্রিল সকাল সাতটায় মনির মাদ্রাসায় যায় পড়তে। বেলা এগারোটা বাজার পরও মনির বাড়িতে না গেলে বাড়ির লোকজন খোঁজখবর নেয়া শুরু করে। পরিবারের সবাই মনিরকে আশপাশের এলাকায় খুঁজতে থাকে। না পেয়ে এলাকায় মাইকিং করে। ওইদিনই ডেমরা থানায় একটি নিখোঁজের জিডি করে পরিবারটি।
ওই রাতেই অজ্ঞাত একটি মোবাইল নম্বর থেকে মনিরের পিতার কাছে ফোন আসে। একটি পুরুষ কণ্ঠে মনিরের মুক্তিপণ হিসেবে তিন লাখ টাকা দাবি করা হয়। মুক্তিপণের টাকা ডেমরা থানাধীন মসজিদুল-ই-আয়েশা জামে মসজিদের ভেতরে থাকা মরদেহ রাখার খাটিয়ার নিচে রেখে আসতে বলা হয়। টাকা না দিলে ছেলের লাশ পাবে বলে হুমকি দেয়া হয় মোবাইল ফোনে।
মনিরের পিতা ঘটনাটি ডেমরা থানা পুলিশকে জানায়। বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে মনিরকে উদ্ধারে অভিযান চালানো হয়। মনিরের পিতা আর প্রযুক্তির মাধ্যমে পাওয়া তথ্য মোতাবেক পরদিন ৮ এপ্রিল মনিরের বস্তাবন্দী হাত-পা বাঁধা লাশ ডেমরার মসজিদুল-ই-আয়েশা জামে মসজিদের ভেতরে থেকে উদ্ধার করা হয়।
পরদিন ৯ এপ্রিল নূর-ই-মাদ্রাসার অধ্যক্ষ আব্দুল জলিল হাদী ও তারই ছাত্র আহাম্মদ সফি ওরফে তোহাকে আটক করা হয়। তারা হত্যার দায় স্বীকারে করে। তাদের দেয়া তথ্য মোতাবেক হত্যাকা-ে সহযোগিতা করার দায়ে রাজধানীর বংশাল থানাধীন মালিটোলা এলাকা থেকে নূর-ই-মদিনা মাদ্রাসার আরেক ছাত্র আকরামকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতারকৃতরা হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে। খুনীদের দেয়া তথ্য মোতাবেক তাদেরই কাছ থেকে হত্যাকা-ে ব্যবহৃত একটি পাতলা তোয়ালে, দুটি সিমেন্টের বস্তা, দুটি কালো রঙের দড়ি, সিমসহ একটি মোবাইল সেট, মৃতদেহের পরনে থাকা গ্যাবারডিন রঙের ফুলপ্যান্ট ও পাঞ্জাবি উদ্ধার করা হয়। শিশু মনিরকে মুক্তিপণের জন্য অপহরণ করার পর তার ওপর পাশবিক নির্যাতন হয়েছে কিনা সে বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে বলে জানান উপকমিশনার।