দেশব্যাপী সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট এবং তাদের প্রতি অব্যাহত অমানবিক আচরণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় উত্তরাঞ্চলের বহু সংখ্যালঘু পরিবার দেশত্যাগ করতে শুরু করেছে। বৃহত্তর দিনাজপুর, রংপুর, পাবনা, বগুড়া এবং রাজশাহীর বিভিন্ন গ্রাম থেকে নির্যাতিত সংখ্যালঘুরা সীমান্তের গ্রাম-জনপদ গুলোতে আত্মীয়-পরিজনসহ আশ্রয় নিচ্ছে পরিচিত-অপরিচিত লোকজন অথবা নিজ সম্প্রদায়ের বাসাবাড়িতে। তারা যে কোনো উপায়ে সহায়-সম্বল ফেলে রেখে চলে যেতে চান সীমান্তের ওপারেগত এক সপ্তাহে পাবনা ও নাটোরের বেশকিছু সংখ্যালঘু পরিবার রাজশাহীর গোদাগাড়ী ও চাঁপাই নবাবগঞ্জের সোনামসজিদ সীমান্তপথে ওপারে চলে গেছে। এছাড়া যেসব সংখ্যালঘু পরিবার এখনো সরাসরি আক্রমণ বা হামলার কবলে পড়েনি, তারাও পরিবার-পরিজনসহ দেশত্যাগের প্রস্তুতি নিচ্ছে। একটি সংস্থা আঞ্চলিক ভিত্তিতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ও তাদের দেশত্যাগের খবর সরকারে উর্ধ্বতন মহলে জানিয়েছে। সংস্থাটি পরিস্থিতিকে ‘অত্যন্ত উদ্বেগজনক’ বলে বর্ণনা করেছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, উত্তরাঞ্চলের সংখ্যালঘু পরিবার গুলোর ওপর হামলার ঘটনা শুরু হয়েছে ২ অক্টোবর রাত থেকে। একটি বিশেষ মহল ২ অক্টোবর রাতে নাটোর জেলার লালপুর উপজেলার গোপালপুরের বিভিন্ন গ্রামে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা চালায়। ওই রাতেই গোপালপুর পৌর এলাকাসহ আশপাশের গ্রামের ৫০টি সংখ্যালঘু পরিবার হামলার শিকার হয়। গোপালপুরের রঞ্জন সাহা গত ৮ অক্টোবর চাঁপাইনবাবগঞ্জের সোনামসজিদ সীমান্তপথে ভারতে চলে গেছেন বলে জানান তার পরিচিতরা। এই এলাকার আরো তিনটি সংখ্যালঘু পরিবার বর্তমানে গ্রাম ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে। সুযোগ-সুবিধামতো পরিচিতজনদের মাধ্যমে এই তিনটি পরিবারও পাড়ি জমাতে চায় সীমান্তের ওপারে। নির্বাচনের পর গত এক সপ্তাহে পাবনার সুজানগর, কাশিনাথপুর, চাটমোহর ও আটঘরিয়া এলাকায় পরিকল্পিতভাবে সংখ্যালঘু পাড়া-মহল্লায় হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। পাবনার চাঁচকৈড়ের সন্তোষ মণ্ডল দুই ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীসহ এলাকা ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন রাজশাহীর পঞ্চবটীর এক আত্মীয়ের বাসায়। দেশ ছেড়ে যাবেন⎯ এই সিদ্ধান্তে অটল সন্তোষ। এখন দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার অপেক্ষায়। সন্তোষ জানান, পাবনা এলাকায় এখনো ৫০ হাজারেরও বেশি সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের বাস। বর্তমানে তাদের সবাই উদ্বিগ্ন নতুন করে হামলার আশঙ্কায়। জানা গেছে, নাটোরের সিংড়া ও তাড়াশ এলাকা ছাড়াও সিরাজগঞ্জের চান্দাইকোনা, উল্লাপাড়া, শাহাজাদপুর, বগুড়ার নন্দীগ্রাম, জয়পুরহাটের পাঁচবিবি, গাইবান্ধা, দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁও এলাকার সংখ্যালঘু হিন্দুরা দেশত্যাগ করে যাচ্ছে। রাজশাহীর বিভাগীয় পর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, নাটোর পাবনা, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট ও রাজশাহী ছাড়া উত্তরাঞ্চলের অন্য এলাকায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু আতঙ্ক আর ভয় সংখ্যালঘুদের মাঝে একটা বড় দুর্বলতার সৃষ্টি করেছে। এ কারণে একটা ভয় থেকেই তারা দেশত্যাগের মতো মর্মান্তিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছে। শুধু সংখ্যালঘু হিন্দুরাই নয়, রাজশাহীতে সংখ্যালঘু আদিবাসীরাও ক্রমাগত একটি মহলের হামলার শিকার হচ্ছে। ২ অক্টোবর রাজশাহীর বাসুদেবপুর ইউনিয়নের গোপালনগর গ্রামের আদিবাসীদের ওপর হামলা হয়। চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা আদিবাসীদের ২৫টি বাড়িতে হামলা চালিয়ে ক্ষয়ক্ষতি করে। আহত হয় ছয়জন। ক্ষতিগ্রস্থ আদিবাসীরা বলেন, থানায় অভিযোগ জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোদাগাড়ী থানা বিএনপির এক নেতা সবার সামনেই পুলিশকে কোনো ব্যবস্থা না নেয়ার জন্য সতর্ক করে দেন। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত পুলিশ আদিবাসীদের অভিযোগটি তদন্ত করেনি। রাজশাহীর দুর্গাপুর ও তানোর এলাকায় সংখ্যালঘু হিন্দু ও আদিবাসীদের ওপর হামলার ঘটনা বেড়ে চলেছে বলে জানিয়েছেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রবীন্দ্রনাথ সরেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগেই আদিবাসীদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি দেয়া হয়েছিলো। নির্বাচন শেষে এখন আদিবাসীদের ওপর হামলা হচ্ছে। তিনি প্রতিকারবিহীন এসব ঘটনা পুুলিশের ভূমিকার সমালোচনা করেন
উত্তরাঞ্চলের জেয়ায় সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ঘটনার ব্যাপারে একজন উর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘সময়টা বড় খারাপ যাচ্ছে। আমরাই বা কি করতে পারি এখন?
প্রথম আলো, ১০ অক্টোবর, ২০০১

মন্তব্য করুন