আইডি, ওদের ছবি তুলবেন না, নাম ছাপাবেন না। ওদের যা হওয়ার হয়ে গেছে। সমাজ-সংসারে ওদের বাঁচার পথ বন্ধ করবেন না, হাত জোর করছি।” তবু ক্যামেরা ক্লিক করে সঙ্গে সঙ্গে ওরা মুখ ঢাকে। ওদের ওপর সন্ত্রাসীরা কোন ধরণের নির্যাতন চালিয়েছে? ওরা মুখ ঢাকছে কেন? নারী প্রগতি সংঘের দুইজন প্রতিনিধিসহ গত ১৪ অক্টোবর গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার রামশীলে ওদের আশ্রয়স্থলে পৌঁছানোর পর আশ্রয়দাতাদের একজন এভাবেই আমাদের কাছে আকুতি জানায়। ওরা কারো স্ত্রী, কারো মেয়ে। একেবারেই অল্প বয়স। নির্যাতনের শিকার হয়ে ওরা মুখ দেখাতে চায় না। ওদের কারো বাড়ি বরিশালের গৌরনদীর উত্তর চাঁদসীতে, কারো বাড়ি অশোককাঠি, কারো বাড়ি কাপালি গ্রামে। সবাই এখন আশ্রয় নিয়েছে রামশীলে। ওদের নাম কল্পনা, মাধবী, সুরভী, রিতা, লক্ষী, অতসী, রীনা আর মনিকা, (ছদ্ম নাম)। ২৩ বছরের সুরভী একজনের স্ত্রী। অশোককাঠিতে ৪ অক্টোবর রাতে একদল সন্ত্রাসী হামলা চালায় ওদের বাড়িতে। স্বামীকে বেদম প্রহার করে, ঘরবাড়ি ভাঙ্গে, তারপর বৃদ্ধ শ্বশুরের সামনেই সুরভীর ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। পালাক্রমে চারজন নির্যাতন করার পর সুরভী অজ্ঞান হয়ে গেলে তাকে ফেলে রেখে চলে যায়। ৫ অক্টোবর ভোরে সে পালিয়ে আসে রামশীলে। ৪ তারিখ রাতে একই গ্রামে ২০ বছরের রিতা পাশবিক নির্যাতনের দ্বিতীয় শিকার সন্ত্রাসীদের হাতে। কয়েক মাস আগে তার বিয়ে হয়েছিল। তারও সমস্ত স্বপ্ন সুখ শেষ হয়ে গেছে। ৩৫ বছরের কল্পনার বাড়ি গৌরনদীর উত্তর চাঁদসীতে। ৩ অক্টোবর রাতে তার বাড়িতে হামলা হয়, বাড়িতে পুরুষ মানুষ কাউকে না পেয়ে তার উপরে পাশবিক নির্যাতন চালায় তিন সন্ত্রাসী। বাকিরা এ সময় উল্লাস করে। ২৫ বছরের মাধবী একজনের স্ত্রী আর ১৫ বছরের লক্ষী নবম শ্রেনীর ছাত্রী, একজন শিক্ষকের মেয়ে। আশককাঠিতে ৫ অক্টোবর রাতে এরা দুইজন পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়। গৌরনদীর কাপালি গ্রামের ১৪/১৫ বছরের তিন তরুণী অতসী, রীনা, মনিকা। ২ অক্টোবর রাতে সন্ত্রাসীরা তিনজনকে তুলে নিয়ে যায় গৌরনদী উপজেলা সদরের একটি বাড়িতে। দু’দিন পাশবিক নির্যাতন চালানোর পর ৪ অক্টোবর ভোরে ওদের ছেড়ে দেয়। ১০/১২ জন নরপশু ওদের ওপর দুইদিন ধরে পালাক্রমে নির্যাতন চালায়। ছেড়ে দেয়ার সময় হুমকি দেয় যদি কাউকে কিছু বলিস তাহলে যেখানে পাব সেখানেই তোদের লাশ ফেলব। উজিরপুর থানার সাতলা গ্রামে ২৮ বছরের এক তরুণীর ওপর পাশবিক নির্যাতনের পর তার দুটি স্তন কেটে নিয়ে সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করে। হতভাগ্য তরুণীর সঠিক নাম জানা যায়নি। রামশীলে উজিরপুর থেকে আসা দুজন জানায়, ওর নাম লক্ষী। আর রামশীলে অন্য একজন জানায়, ওর নাম লাভলী। তবে আর বেশী কিছু জানা যায়নি এই তরুণীর মৃত্যু সম্পর্কে। কারণ উজিরপুর যাওয়া সম্ভব হয়নি। উজিরপুরে এখন ’৭১-এর চিহ্নিত রাজাকার কালু হাজী আর তার সাঙ্গপাঙ্গ সন্ত্রাসীদের বেপরোয়া সন্ত্রাস চলছে বলে জানালো রামশীলের আশ্রিতরা। পাশবিক নির্যাতনের শিকার এই নারীরা কেউই কথা বলতে চায়নি। যাদের কথা জানালাম তাদের মধ্যে দেখা পাই ছয়জনের। সবাই দু’হাতে মুখ চেপে কেঁদেছে। পরে আশ্রয়দাতাদের একজন নির্যাতনের বর্ণনা দেয়, নাম-ঠিকানা প্রকাশ না করার শর্তে। পাশবিক নির্যাতনের সাথে জড়িত যেসব সন্ত্রাসীদের নাম পাওয়া গেছে তারা হচ্ছে কাসেম জমাদ্দার, জয়নাল শিকদার, নাসির সরদার, বাচ্চু সরদার, অজিত হালাদার এরা গৌরনদী, আগৈলঝাড়া এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী। নির্যাতিতদের ভয় এখনও কাটেনি। আবারও নির্যাতনের শিকার হতে পারে তারা। এদের নিরাপত্তা দেবে কে?
সংবাদ, ১৬ অক্টোবর ২০০১