উত্তর জনপদের স্থলবন্দর হিলি এখন একটি থমথমে জনপদ। নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় ভীতসন্ত্রস্ত সংখ্যালঘুরা এ পথে দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন নীরবে। ক্ষমতার পালাবদলের পর বিএনপির ক্যাডাররা চোরাচালানের ঘাট সমূহের নতুন দখল নিয়েছে। নতুন দখলদারদের নানা ভূমিকায় সেখানে বিরাজ করছে সন্ত্রস্ত, থমথমে এক পরিস্থিতি। এসব চোরাইঘাট পথেই মোটা টাকার বিনিময়ে সংখ্যালঘু পরিবারগুলোকে পার করে দেয়া হচ্ছে সীমান্তের ওপারে। হিলি স্থলবন্দরে এখন সেখানকার মানুষ চোখ-কান পাতলেই সীমান্তলাগোয়া গ্রামগুলোতে দেশ ত্যাগের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে এসে জড়ো হওয়া ভীতসন্ত্রস্ত সংখ্যালঘু পরিবারগুলোর উপস্থিতি টের পায়। এদের অনেকে পরিচয় গোপন করে অবস্থান করে বিভিন্ন গ্রামে। বয়স্ক হিন্দু-পুরুষরা নিত্য অভ্যাসের ধুতি পরে না সহজে। মেয়েরাও সিঁথিতে সিঁদুর এড়িয়ে চলতে চায়। পূজার উৎসব ওপারের স্বজনদের সঙ্গে মিলেমিশে উপভোগের জন্য নয়, তারা দেশ ছাড়ছে প্রাণ ভয়ে। এই ভয় তৈরি হয়েছে পহেলা অক্টোবরের নির্বাচনের পর। রাত নামলেই এরা দালালের হাত ধরে পাড়ি দেয় জন্মভূমির সীমান্ত। হিলির সীমান্ত এলাকার সূত্রগুলো বলেছে, হাড়িপুকুর, আটাপাড়া, দক্ষিণপাড়া, হিলি স্টেশন, ফুটবল মাঠসহ বিভিন্ন চোরাচালান ঘাট পথে এসব নীরব দেশ ত্যাগের ঘটনা ঘটছে। জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার সীমান্ত লাগোয়া বিভিন্ন পথেও চলছে দেশ ত্যাগ। স্থানীয় সূত্রগুলোর কাছে এ ব্যাপারে পরিবার ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট তথ্য তেমন নেই। এভাবে যারা সীমান্ত অতিক্রম করে যায় তাদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট তথ্যও থাকে না। বিভিন্ন সূত্র বলেছে, আসছে-যাচ্ছে এটাই দেখছি। তবে হিলি স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে বিধিসম্মত পাসপোর্ট ভিসায় যারা গেছেন তাদের তথ্য-পরিসংখ্যান আছে। স্বল্প সময়ের ভিসায় প্রচুর পরিমাণে ব্যাগ-লাগেজসহ যারা গেছেন তারা কতদিনে দেশে ফিরবেন বা আদৌ ফিরবেন কিনা তা কেউ জানে না। স্থানীয় সূত্রগুলোর মতে, রাতে সীমান্ত পথে যারা চলে যাচ্ছেন তাদের বেশীরভাগ খুলনা-বাগেরহাট এবং বৃহত্তর কুষ্টিয়া এলাকা থেকে আসা লোক। গ্রাম গুলোতে পৌঁছাবার পর তারা স্থানীয় লোকজনকে দেখা-সাক্ষাত দিচ্ছেন কম; কথা-বার্তাতো দূরের কথা। বাগেরহাটের বাটাজোর গ্রামের সুরেন্দ্রনাথ (৫৪) পরিবার নিয়ে হাড়িপুকুর চোরাই সীমান্ত ঘাট দিয়ে দেশ ছেড়েছেন ৬ অক্টোবর রাতে। সীমান্তে এসব পাচারে সহযোগী দালালের স্থানীয় নাম ‘ধুর’। সুরেন্দ্রনাথের পরিবারকে সীমান্ত ত্যাগে সহযোগিতা করেছে ধুর সিরাজ। স্ত্রী , দুই পুত্র-কন্যা সহ তারা গেছেন মোট ৪ জন। কুষ্টিয়ার দৌলতপুরের বড়গাংদিয়া গ্রামের দিলীপ কুমারের পরিবারের ৭ সদস্য জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলার চেঁচড়া গ্রামের চোরাই সীমান্ত পথে ভারতে চলে গেছেন অক্টোবরের ১১ তারিখ। এই পরিবারটি ওই সীমান্তবর্তী গ্রামে পৌঁছে অপেক্ষায় ছিল ওপারের আত্মীয়স্বজনের জন্য । তারাই রাতের বেলা গোপনে এসেপরিবারটিকে নিয়ে গেছে নিজস্ব নিরাপদ ভুমিতে। মানিকগঞ্জের যতীন্দ্রনাথ সরকারের (৫৩) দেশত্যাগী পরিবারটিতে ছিল ৫ সদস্য। কুষ্টিয়ার বড়গাংদিয়ার ব্যবসায়ী সুরঞ্জিতের (৫৮) পরিবারটির কথা বললেন দক্ষিণপাড়া গ্রামের মানুষ জন। ওই গ্রামের সীমান্ত পথেই পরিবারটি চলে গেছে রাতের আঁধারে। আবার গত ১৭ তারিখে সাভারের নরেশ চন্দ্র পালের (৬৫) পরিবারটি পাসপোর্ট ভিসায় বৈধ ভাবে ভারতে গেছে। হিলি স্থলবন্দরের ইমিগ্রেশন বিভাগের একটি সূত্র বলেছে, ১ অক্টোবর থেকে ১৭ তারিখ পর্যন্ত ওই সীমান্ত পথে বাংলাদেশ থেকে ৪৪৩ যাত্রী ভারতে গেছেন। ভারত থেকে এসেছেন ২৮৭ জন। এই সময়ে ১৮ জন ভারতীয় যাত্রী এসেছিল। তাদের ১৭ জন এর মাঝে ফিরে গেছেন ভারতে। সূত্রটি বলেছে, এই সময়ের মধ্যে যারা ভারতে গেছে তাদের ২৭৮ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাদের ভিসার মেয়াদ বেশী দিনের নয়। কিন্তু একেকটি পরিবার এতবেশী বাক্স-পোটলা সঙ্গে নিয়ে গেছেন যে- আসলে তারা কবে দেশে ফিরবেন বা আদৌ ফিরবেন কিনা তা নিয়ে অনেকেরই সন্দেহ হয়েছে। সীমান্ত অতিক্রমের সময় তাদের কেউ কেউ দেশের দিকে চেয়ে অঝোরে কাঁদছিলেন।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ২০ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন