তালুকদার পদবির এক ব্যাংকার। নির্বিরোধী মানুষ। বাড়ি হরিদেবপুর গ্রামে। উপজেলা সদরের নদীর ওপাড়েই এ গ্রাম। নির্বাচনের কয়েকদিন পরের ঘটনা। এ গ্রামের মহিউদ্দিন বাহিনী তার কলেজপড়ুয়া দুমেয়েকে তাদের হাতে তুলে দিতে বলে। এ ঘটনার পর দু’মেয়েকে নিয়ে তিনি এলাকা ছেড়েছেন। এখন থাকেন উপজেলা সদরে। সংখ্যালঘু পরিবারটি এখন শঙ্কিত। গাবুয়া গ্রামের ধর্মপ্রাণ এক ব্যক্তি আশ্রমে আশ্রমে ঘুরে বেড়াতেন। তাঁর কাছে গিয়েও হরিলুটের বাতাসা খাওয়ার আবদারের মতো তার যুবতী কন্যাসন্তানটি দাবি করে একই বাহিনী। এই সাধু এখন তার মেয়ে নিয়ে এলাকা ছেড়েছেন। আরেকটি ঘটনা এক এনজিও কর্মীর। ওই এনজিও কর্মীর বাড়িও হরিদেবপুর গ্রামে। সন্ত্রাসীরা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পক্ষে কাজ করার অজুহাত তুলে তার স্ত্রীর সম্ভ্রমহানি করার চেষ্টা চালায়। এমন আরও অনেক ঘটনা শুনতে পাওয়া যায় গলাচিপার কারো সঙ্গে একান্তে আলাপ করলে। গলাচিপায় আবারো উৎপাত শুরু করেছে সর্বহারা নামধারী সন্ত্রাসীরা। শোনা যায়, সরকারী দলের এক প্রভাবশালী নেতার সঙ্গে এদের যোগাযোগ রয়েছে। নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাসের মধ্যে দিয়ে এখানে আবার এরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। নির্বাচনের পরপর গলাচিপা হয়ে ওঠে সন্ত্রাসের জনপদ। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর হয়ে ঠে বিএনপির সন্ত্রাসীদের হামলার লক্ষ্যবস্তু। এদের তাণ্ডবে অনেকেই গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এখন উপজেলা সদরে আশ্রয় নিয়েছে। চলছে চাঁদাবাজি অবাধে। নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাস এখনো অব্যাহত রয়েছে। গলাচিপায় পা দেয়ার পর থেকে শুরু করে ফেরার আগ পর্যন্ত আমাদের মধ্যযুগীয় ঘটনার নানা বর্ণনা শুনতে হয়েছে। এসব বর্ণনা শুনতে শুনতে মাঝে মাঝে মনে হয়েছে বাস্তবে আছি নাকি দুঃস্বপ্ন দেখছি। এবারের জাতীয় নির্বাচন এমন কুৎসিত অভিজ্ঞতার জন্ম দেবে তা কারো ধারণাতেই ছিল না। নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি জানার জন্য কথা হয় গলাচিপার ব্যবসায়ী, রাজনীতিক, শিক্ষকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের সঙ্গে। নির্বাচন শেষ হওয়ার পরপরই গলাচিপায় বিএনপি নামধারীদের নেতৃত্বে বিভিন্ন বাহিনী গড়ে ওঠে। গোলখালী ইউনিয়নে গড়ে উঠে মহিউদ্দিন বাহিনী। হরিদেবপুর গ্রামের যাদব ডাক্তারের কাছে এ বাহিনী দশ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। শঙ্কিত যাদব ডাক্তার এখন গ্রামের বাড়ি ছেড়ে গলাচিপা উপজেলা সদরে আশ্রয় নিয়েছেন। নির্বাচনের ছয়-সাত দিন পরে মহিউদ্দিন মুদি ব্যবসায়ী হরেন শীলকে বেধড়ক মারধর করে। হরেন শীল এখনো পুরো পরিবার নিয়ে এলাকাছাড়া। এ ইউনিয়নের প্রবীণ শিক্ষক ভবেশ রায়কে ৯ অক্টোবর রাতে তার বাড়ির সামনের রান্নায় মুখে গামছা গুঁজে দিয়ে বেধড়ক পেটায়। ছেড়ে দেওয়ার সময়ে ‘শালা মালাউনের বাচ্চা কাউকে বলবি তো শেষ করে দেবো’ বলে শাসিয়ে যায়। এ ঘটনার পরপর ভবেশ রায় ভারতে চলে গেছে বলে অনেকে জানিয়েছে। তার স্ত্রী ঊষা রাণী এখনো আতঙ্কে দিন কাটায়। সুকুমার রায় গরিব কৃষক। তার হাত থেকে দিনেদুপুরে খুলে নেয়া হয়েছে স্বর্ণের আংটি, ঘর থেকে নিয়ে গেছে রেডিও। ওই ইউনিয়নের বিধবা বিড়লা রানী রায়কে তার বাড়িতে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু প্রতিবেশীরা আগুন নিভানোর কারণে তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এসব ঘটনার নায়ক মহিউদ্দিনকে পুলিশ সুপার মাইনুর রহমান চৌধুরীর নির্দেশে গ্রেপ্তার করা হয়। গত মঙ্গলবার সে ছাড়া পেয়েছে। ছাড়া পাওয়ার পর আবার সে এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করছে। সোনালী ব্যাংকের কর্মী রমেন বিশ্বাসের কাছে জেলে যাওয়ার আগে দশ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করেছিলো মহিউদ্দিন। সেই চাঁদার টাকা পরিশোধের জন্য আবার রমেন বিশ্বাসকে চাপ দেয়া হয়েছে। রতনদী তালতলী ইউনিয়নে কাছারিকান্দা গ্রামের রঞ্জন মালাকারের বাড়ির পুকুরের মাছ বিএনপির মতলেব মিস্ত্রী জোর করে নিয়ে যায়। নির্বাচনের পরপর উপজেলা সদরে বাসুদেব দুয়ারী এবং গলাচিপা কলেজের সহকারী অধ্যাপক সন্তোষ কুমার দে’র বাড়িতে বিএনপি ক ̈াডাররা হামলা চালিয়ে ভাংচুর করে।
দৈনিক জনকণ্ঠ, ৮ নবেম্বর ২০০১