জামালপুর থেকে নির্বাচনপরবর্তী সহিংসতায় জামালপুর জেলার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে। বাড়িঘরে হামলা, নির্যাতন, চাঁদা দাবি, সম্ভ্রমহানির হুমকি-ধমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের মুখে সংখ্যালঘু পরিবারের নারী-পুরুষ ও শিশুরা পর্যন্ত ভয়ে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই বহু পরিবার ঘরছাড়া হয়েছে। ভাংচুর ও তছনছ করা হয়েছে দুর্গা প্রতিমা। হরিজন ও ঋষি সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। এসব ঘটনায় জেলায় এবার শারদীয় দুর্গোৎসবের কোন আমেজ নেই, উৎসাহ-উদ্দীপনা নেই। তেমন আড়ম্বরপূর্ণ কোন আয়োজনও নেই হিন্দু সম্প্রদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব দুর্গা পূজা উৎযাপনের। সর্বত্র যেন বিষন্নতার ছায়া নেমেছে। দুর্গাপূজার আয়োজনের শেষ মুহূর্তে গত সোমবার রাতে জেলার সীমান্তবর্তী বকশীগঞ্জ উপজেলার বগারচর ইউনিয়নে সারমারা বাজার সংলগ্ন দাসপাড়ায় দুর্গা ও কালী প্রতিমা ভাংচুর ও তছনছ করা হয়েছে। রাত অনুমান দেড়টার সময় এক দল দুর্বৃত্ত দাসপাড়া গ্রামে ঢোকে। এ গ্রামের ক্ষুদিরামের বাড়ি সংলগ্ন কালী মন্দিরে তারা চড়াও হয়। এই মন্দিরের সামনেই এবার দুর্গা পূজা উদ্যাপনের মণ্ডপ তৈরি করা হয়েছিল। দুর্বৃত্তরা হামলা-তাণ্ডব চালিয়ে দুর্গা প্রতিমা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। এ সময় তারা কালী মন্দিরে ঢুকেও তাণ্ডব চালায় এবং কালী প্রতিমা ভাংচুর করে। গ্রামের সংখ্যালঘু পরিবারের সদস্যরা চোখের সামনে এ তাণ্ডব দেখেও বাঁধা দিতে সাহসী হয়নি। নীরবে অশ্রু সংবরণ করে নির্বাক তাকিয়ে দেখেছে বর্বরোচিত এই হামলা-তাণ্ডবের দৃশ্য । বকশীগঞ্জের সারমারা বাজার সংলগ্ন দাসপাড়া গ্রামে প্রায় দেড়’শ সংখ্যালঘু জেলে পরিবার বসবাস করে। এককালে গ্রামে সম্ভ্রান্ত পরিবারের বসতি ছিল। তাদের দেশত্যাগের পরও উক্ত গ্রামে নীরিহ নিম্নবিত্ত জেলে পরিবারগুলো বসবাস করে আসছে। ঐতিহ্য রক্ষায় স্থানীয় সংখ্যালঘুরা প্রতিবছর সেখানে দুর্গা পূজার আয়োজন করে থাকে। দেশ স্বাধীনের পর এখানে কখনও এমন বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেনি। এই প্রথম তাদের দুর্গোৎসবের আয়োজন ভণ্ডল করে দেয়া হয়েছে। ম্লান হয়ে গেছে জেলেদের আসন্ন পূজার আনন্দ। দুর্বৃত্তরা হামলা-তাণ্ডবের সময় তাদের গ্রাম ছেড়ে চলে যাবার হুমকি দিয়েছে। বলেছে, অন্যথায় তাদের মেরে ফেলা হবে। জানা গেছে, স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াতের সশস্ত্র কর্মীরা নির্বাচনের পর থেকেই সেখানে মহড়া দিতে শুরু করে। কয়েকদিন ধরে তারা সংখ্যালঘুদের এবার দুর্গোৎসব পালন না করার জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন ও হুমকি-ধমকি দিয়ে আসছিল। এদিকে মঙ্গলবার জেলা শহরে পূজা উপলক্ষে চাঁদাবাজি করতে গিয়ে সংখ্যালঘু হরিজনদের সঙ্গে বিএনপি ক্যাডারদের সংঘর্ষ হয়েছে। বেলা ৩টার দিকে বজরাপুরে মেথরপট্টিতে ঘটেছে এ ঘটনা। হরিজনরা জানায়, বিএনপি ক্যাডাররা তাদের কাছে ৫ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে তাদের পূজা মণ্ডপ ভেঙ্গে ফেলার হুমকি দেয়। এ নিয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বিএনপির সশস্ত্র ক্যাডাররা হরিজনদের উপর হামলা চালায়। এবং মনোহর বাঁশফোরকে কুপিয়ে আহত করে। এ ছাড়া তারা হরিজনদের ঘর-দরজা কুপিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ করে। এক পর্যায়ে প্রতিরোধের মুখে চাঁদাবাজ হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। এ ঘটনার পর সন্ত্রাসীরা হরিজনদের উচ্ছেদের হুমকি দিচ্ছে। এর আগে সরিষাবাড়ী উপজেলার বাউসীতে ঋষি সম্প্রদায়ের উপর হামলা করে ১০টি পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। পিংনায় উত্তম চৌধুরীর বাড়িতে হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় জেলার সংখ্যালঘুরা আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছে। এবার তাদের পূজা হবে কিনা তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। গত বছর এ সময় জেলায় শারদীয় দুর্গোৎসব উদ্যাপনের ব্যাপক আয়োজন লক্ষ্য করা গেছে। পূজা উপলক্ষে কেনাকাটার ধুম পড়ত, দোকানিরা তাদের পসরা সাজিয়ে বসত। জেলায় গত বছর শতাধিক পূজা মণ্ডপে দুর্গা পূজা হয়েছে। প্রতিটি পূজা মণ্ডপ ছিল সাড়ম্বরপূর্ণ। হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরে ঘরে উৎসবের আমেজ বিরাজ করত। নির্বাচনোত্তর সহিংসতায় এবার উৎসাহ-উদ্দীপনা ম্লান হয়ে গেছে। নীরবে চলছে চাঁদাবাজদের সন্ত্রাস, চাঁদা না দিলে হুমকি দেয়া হচ্ছে পুজা মণ্ডপ ভেঙ্গে ফেলার। ধর্মীয় উৎসব পালনে এমন বিড়ম্বনার মধ্য এবার পূজা আয়োজন চলছে অনাড়ম্বরপূর্ণ। কিছু জায়গায় এক রকম চাপে পড়ে পূজার আয়োজন চলছে। পূজা না করলেও দেশছাড়া করার হুমকি দেয়া হচ্ছে। এমন অরাজক পরিস্থিতিতে আদৌ পূজা উদ্যাপন সম্ভব কিনা সন্দেহ রয়েছে।
দৈনিক জনকন্ঠ, ১৯ অক্টোবর ২০০১