হিন্দু সম্পদায়ের বৃহত্তম উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা চলাকালীন দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। নওগাঁর গ্রামে একটি পূজামণ্ডপ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। প্রশাসন এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতার না করে উল্টো পূজা কমিটির লোকজনদের নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। কুলাউড়া উপজেলার চা বাগানের পূজামণ্ডপে সন্ত্রাসীরা হামলা চালিয়ে প্রতিমার ক্ষতিসাধন করে। নাটোরের সিংড়া উপজেলার এক মণ্ডপে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় সন্ত্রাসীরা পূজা মণ্ডপে চড়াও হয়। হামলায় ৯ জন আহত হয়। মুন্সীগঞ্জে সন্ত্রাসীরা এক সংখ্যালঘুকে বেদম মারপিট করেছে। আমাদের সংবাদদাতারা এসব খবর জানিয়েছেন। নওগাঁ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, বৃহস্পতিবার রাতে নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার দক্ষিণ আখেড়া বারোয়ারীর পূজা মণ্ডপটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দুর্গাসহ কাঠামের প্রতিটি প্রতিমা পুড়ে ছাড়খার হয়েছে। শুক্রবার ওই মণ্ডপে ভক্তরা মহাদশমী পূজার পুষ্পার্ঘ দেবী দুর্গার চরণে দিতে পারেনি। কমিটির ২২ জন পুরুষ সদস্য মাথা মুণ্ডন করে (ন্যাড়া হয়ে), মহিলা ভক্তবৃন্দসহ একটানা তিন দিন জল স্পর্শ না করে তে-রাত্রি পালন করেছে। মা-বাবার মৃত্যুর পরে যেমন অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করতে হয়, ঠিক সেভাবে তারা শোক পালন করছে। এই শোক পালনেও বাঁধ সাধছে প্রশাসন। শুক্রবার পূজা মণ্ডপ পুড়িয়ে দেয়ার প্রতিবাদে ওই গ্রামের হিন্দুরা মৌন মিছিল করতে চাইলে পুলিশ তা করতে দেয়নি। পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতা বিশ্বনাথ ও পূজা কমিটির রবীন্দ্র নাথ ঘোষ জানান, ঘটনার পর পুলিশ দোষী ব্যক্তিদের সন্ধান না করে উল্টো পূজা কমিটির লোকজনদের নানাভাবে হুমকি ধমকি দিচ্ছে। শুক্রবার বিকালে সরেজমিনে আখেড়া পূজামণ্ডপে উপস্থিত হয়ে চোখে পড়ে পূজামণ্ডপের এবং প্রতিমার ভষ্মীভূত চেহারা। ভক্তরা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। পাশেই বসা ছিলেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, মহাদেবপুরের ইউএনও, ওসিসহ পর্যাপ্ত পুলিশ। সাংবাদিক পরিচয় জেনে ওই গ্রামের হিন্দুরা বিবরণ দিতে থাকে মণ্ডপ পোড়ার সময় এবং পরবর্তীতে প্রশাসনের জুলুমের কথা। এডিএম এবং পুলিশ কর্মকর্তারা ওই মণ্ডপটি তড়িঘড়ি করে ভেঙে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। ডুবিয়ে দিতে বলা হয়েছে ভষ্মীভূত প্রতিমাগুলো। গ্রামবাসী জানান, এই পোড়া প্রতিমা নিয়ে কোন রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হলে আখেড়া গ্রামের হিন্দুদের দেখে নেয়ার হুমকি দিয়েছে পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের কর্মকর্তারা। মৌলভীবাজার থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুরে কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নের পাল্লাকান্দি চা বাগানের পূজামণ্ডপে কতিপয় সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। সন্ত্রাসীদের হামলায় প্রতিমার কয়েকটি আঙ্গুল ভেঙ্গে যায়। এ ব্যাপারে পূজামণ্ডপের সভাপতি বাদুরি লাল রবিদাশ বাদী হয়ে কুলাউড়া থানায় মামলা দায়ের করলে পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে খালেক (১২), জায়েদ (১৮), আবু মিয়াকে (১৩) গ্রেফতার করে । ঘটনার পর পুলিশ সুপার কুলাউড়ার ইউএনও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। ঘটনাস্থলে পুলিশ ও বিডিআর মোতায়েন করা হয়েছে। এ ব্যাপারে পুলিশ জানায়, একটি গরুর বাছুর মারা যাওয়ার জের ধরে পূজামণ্ডপে এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর হামলা চালায়। এতে প্রতিমার কয়েকটি আঙ্গুল ভেঙ্গে যায়। এ ছাড়া জেলার কোথাও গোলযোগ ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে অনাড়ম্বর পরিবেশে হিন্দু সম্পদায়ের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে শুক্রবার শেষ হয়েছে। নাটোর থেকে সংবাদদাতা জানান, পূজামণ্ডপে দর্শনার্থী মেয়েদের উত্ত্যক্ত করার জের ধরে নাটোরের সিংড়ায় সন্ত্রাসীদের হামলায় আহত হয়েছে ৯ জন। এদের মধ্য ২ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলা হয়েছে। পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেফতার করেছে। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ জানায়, বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে সিংড়া উপজেলার নওগাঁ পূজামণ্ডপে দর্শনার্থী মেয়েদের উক্ত্যক্ত করতে থাকে একদল যুবক। আয়োজকদের পক্ষ থেকে বাধা দেয়ায় তারা সংঘবদ্ধ হয়ে পূজামণ্ডপে চড়াও হয়। মুন্সীগঞ্জ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলায় লিটন দাস (২৫) নামের এক সংখ্যালঘুকে বৃহস্পতিবার বিকালে সন্ত্রাসীরা বেদম প্রহার করেছে। তাকে মুমূর্ষ অবস্থায় সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া একই উপজেলার চর আব্দুল্লাহ গ্রামের কমপক্ষে ৩০টি বাড়ি ভাংচুর এবং লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। জামালপুর থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, নীরবে প্রতীমা বিসর্জনের মাধ্যমে জামালপুরের এবারের শারদীয় দুর্গাপূজার অনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। জেলার কোথাও প্রতীমা বিসর্জনের উৎসব পালিত হয়নি।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ২৭ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন