বরিশালের তিনটি নির্বাচনী আসনে সব প্রার্থীদের ‘মূল টার্গেটে’ পরিণত হয়েছেন সংখ্যালঘুরা। ভোটের ফলাফল নির্ধারণে বরাবরই সংখ্যালঘুদের প্রভাব মুখ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু আগের যে কোন সময়ের চেয়ে এবার তাদের ওপর চাপটা বেশি। তাই তাদের নিরাপদে ভোট প্রয়োগের বিষয়টি এখন প্রশ্নের সম্মুখীন। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকায় আতঙ্ক দ্রুত বাড়ছে। এলাকাগুলো ঘুরে জানা গেছে এ পরিস্থিতি।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারা দাবি জানাচ্ছে, অন্ততপক্ষে ভোটের দুই/তিনদিন আগে থেকে এলাকাগুলোতে সার্বক্ষণিক সেনা বা বিডিআর সদস্য মোতায়েন করার, নয়তো তাদের পক্ষে ভোট প্রয়োগ করা দুরূহ হয়ে উঠবে। ইতিমধ্যেই বিভিন্ন এনজিও সংস্থা, রাজনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন গৌরনদী, আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, বাবুগঞ্জ, বানারীপাড়া এলাকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। পত্রপত্রিকায় প্রতিদিনই ওই সব স্থানের কোথাও না কোথাও সংখ্যালঘু ভোটারদের ওপর হামলা, নির্যাতন, অত্যাচার ও হুমকির খবর ছাপা হচ্ছে ফলাও করে।

পাশাপাশি নির্বাচনী এলাকাসমূহের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরও সংখ্যালঘুদের ওপর ‘চাপের’ কথা স্বীকার করে দায়ী করেছেন একে অন্যকে। আবার কেউ চেষ্টা করছেন এ বিষয়ে মাথা না ঘামানোর।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ সূত্র জানায়, বরিশাল-১ (গৌরনদী-আগৈলঝাড়া), বরিশাল-২ (উজিরপুর-বাবুগঞ্জ) ও বরিশাল-পিরোজপুর সংযুক্ত (বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠি) আসন তিনটির প্রতিটিতে গড়ে প্রায় ৩০ শতাংশ রয়েছেন হিন্দু এবং কিছুসংখ্যক খ্রিস্টান ভোটার। এদের মধ্যে সংখ্যাধিক্য রয়েছে আগৈলঝাড়া, উজিরপুর, বানারীপাড়া ও স্বরূপকাঠি এলাকায়। আর এসব এলাকাতেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় পৌছেছে নির্যাতন-অত্যাচার।

বিশেষ করে কোনো কোনো দলের বা প্রার্থীর পক্ষ থেকে প্রথমত, তাদের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হয়। এতে সন্তোষজনক প্রতিক্রিয়া না পেলে তখন চালানো হয় হামলা, নির্যাতন ও এলাকা ছেড়ে যাওয়ার এবং ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার হুমকি। বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই, চলছে লুটপাটও। আর প্রতিটি আসনেই একাধিক প্রার্থীর পক্ষ থেকে সৃষ্টি করা হয় এমন পরিস্থিতি। আবার কোনো কোনো দলের বা প্রার্থীর পক্ষ থেকে পাল্টা হুমকি ও ভয়-ভীতি দেখানো হচ্ছে ভোটকেন্দ্রে না গেলে বা ভোট না দিলে পরবর্তী পরিণতি ভয়াবহ হবে। ফলে শারীরিক বা বৈষয়িক ক্ষতির পাশাপাশি প্রচণ্ড মানকিক চাপের শিকার হয়েছেন তারা।

গৌরনদী-আগৈলঝাড়া এলাকায় হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ নেতা বাবু কালিয়া গুহ জানিয়েছেন, গত কদিনে তার এলাকায় ১০০টিরও বেশি হিন্দু পরিবার হামলা ও সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। এ জন্য স্থানীয় থানায় দুটি জিডিও করা হয়েছে।

উজিরপুরের এক হিন্দু নেতা জানান, স্থানীয় চারটি ইউনিয়নের ভোটাররা এবার নজিরবিহীন আতঙ্কের মধ্যে আছেন। সব প্রার্থীর টার্গেটই তাদের দিকে। কেউ চাচ্ছেন যেকোনোভাবে কেন্দ্রে যেতেই হবে। তাই এখানে সার্বক্ষণিক সেনা সদস্য মোতায়েন জরুরি। এদিকে সংখ্যালঘু ভোটারদের ওপর চাপ সৃষ্টি ও অত্যাচার প্রসঙ্গে প্রথম আলোর কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিভিন্ন প্রার্থী বা তাদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনকারীরা।

বরিশাল-২ আসনে ১১ দল প্রার্থী রাশেদ খান মেনন বলেছেন, এলাকার সংখ্যালঘু ভোটারদের বড় একটি অংশ আমার সমর্থক। তাই অভি, আলাল এমনকি হাসানাত আব্দুল্লাহর লোকজন তাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে আমাকে ভোট না দেওয়ার জন্য।

বরিশাল-১ ও ২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী আবুল হাসানাত আব্দুল্লাহ নির্বাচন পরিচালনার অন্যতম দায়িত্বশীল ব্যক্তি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহসভাপতি বলরাম পোদ্দার জানান, বিএনপির দুই প্রার্থীই (২ আসনে) নিজেদের পরাজয় ঠেকাতে এখন স্রেফ ‘হিন্দু ঠেকাও’ তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা বিন্দুদের এলাকা খুঁজে খুঁজে সন্ত্রাসী তাণ্ডব চালিয়ে আসছে। বরিশাল-১ আসনের চারদল (বিএনপি) প্রার্থী জহিরুদ্দিন স্বপনের ভাই মোহন এবং বরিশাল-২ আসনের এক বিএনপি নেতা জানান, তাদের পক্ষ থেকে কোথাও কোনো হিন্দু পরিবার বা এলাকায় কোনো প্রকার হুমকি প্রদর্শন, ভয়-ভীতি বা অত্যাচারের ঘটনা ঘটেনি। এটা আ’লীগের কাজ।

বরিশাল-২ আসনে জাপা(ম) প্রার্থী গোলাম ফারুক অভি প্রসঙ্গটি এড়িয়ে বলেছেন,আমার কাছে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরু বলে কোনো বিষয় নেই। আমি সবাইকে ‘সান অফ দ্য সয়েল’ মনে করি। একই আসনের জাপা (এ) প্রার্থীর ভাই ডা. গোলাম আম্বিয়া জানান, তারা হিন্দু মুসলমান কাউকেই হুমকি দেননি। সেটা করছে অপর চার প্রার্থী। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন থেকে বলা হয়েছে, সংখ্যালঘু ভোটারদের নিরাপত্তায় সরকার সব ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে।

প্রথম আলো, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০০১

মন্তব্য করুন