যখনই নির্বাচনের ঘোষণা আসে, তখন থেকেই আতঙ্ক আর নিরাপত্তাহীনতার বেড়াজালে আটকে যায় চারটি গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা। এবারও তার ব্যাতিক্রম ঘটেনি। কোন নির্বাচনেই তারা সহজে ভোট দিতে পারেনা। এরা যেন ভোট দিতে না পারে সেজন্য থাকে সতর্ক প্রহরা। এখন থেকেই তাদেরকে নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে, হুমকি দেয়া হচ্ছে। তারা আশংকা করছেন এবারও বোধহয় তাদের ভোট দেয়া সম্ভব হবে না। ইতোমধ্যে তাদের নেতৃস্থানীয়দের উপর হামলা শুরু হয়েছে। এই মুক্তিযোদ্ধা ও নারী ইউপি সদস্য এলাকা ছেড়ে প্রাণভয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। অনেকে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে হয়রানির অভিযোগ বিএনপি’র স্থানীয় ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। বানারীপাড়া থানার চারটি গ্রাম সরেজমিন ঘুরে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বরিশাল থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার দূরের উপজেলা বানারীপাড়া। সেখান থেকেও কয়েক কিলোমিটারের পথ বাইশারী ইউনিয়ন। প্রমত্তা সন্ধ্যা নদী পেড়িয়ে যেতে হয় সেখানে। এ ইউনিয়নের পশ্চিম বাইশারী, দক্ষিণ বাইশারী, ডুমুরিয়া, দত্তপাড়া গ্রামের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এখন চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে বসবাস করছে। গত ২১ আগস্ট মঙ্গলবার আমরা ঐ চারটি গ্রামে যাই। স্থানীয়দের সাথে আমরা কথা বলে জানতে পারি নানা কাহিনী। তারা এতোই আতংকগ্রস্ত যে, মুখ খুলতে পর্যন্ত সাহস করেন না। তারা আমাদের বলেছেন এ নিয়ে পত্রিকায় লেখালেখি হলে তাদের উপর আরো বেশি নির্যাতন চলবে। অনেকেই আমাদের অনুরোধ করেছেন রিপোর্ট না করার জন্য।

আমরা জানতে পেরেছি, নির্বাচন এলেই তারা যেন ভোট কেন্দ্রে যেতে না পারে, ভোট দিতে না পারে সেজন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চলে। আর এ প্রচেষ্টা চালায় বিএনপির স্থানীয় সন্ত্রাসীরা। আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের পরপরই এ গ্রামগুলোতে তাণ্ডব শুরু হয়ে গেছে। বিএনপি সমর্থক একটি বাহিনী তৈরি হয়েছে। এ বাহিনীর নাম বিচ্ছু বাহিনী। এ বাহিনীর কাজ হচ্ছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে উত্যক্ত করা। তারা এদের অকারণে মারধোর, হুমকি, চাঁদাবাজি করে। তাদের তাণ্ডবে ইতোমধ্যে গ্রাম চারটির সংখ্যালঘু পরিবারগুলো শঙ্কা আর আতংকের শিকার হয়েছে। এ বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ১৪ থেকে ২০ বছর বয়সী কিশোর অপরাধীদের সংখ্যাই বেশি। বাইশারী গ্রামের বিএনপি সমর্থক ঠিকাদারী ব্যবসা ও ইটের ভাটার মালিক খালেক মৃধার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনিই এ গ্রুপটিকে লালন করেন। তার ছেলে মিন্টু এই বাহিনীর অন্যতম হোতা। অভিযোগ করা হয়েছে, খালেক মৃধা প্রতিদিন সকালে এ গ্রুপটিকে নাস্তা খাবার টাকা দেন। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের উপর মানসিক চাপ সৃষ্টির জন্য এ চারটি গ্রামের নেতৃস্থানীয়দের উপর শারীরিক নির্যাতন শুরু হয়েছে। বাইশারী ইউনিয়নের পশ্চিম বাইশারী গ্রামের বাসিন্দা ও নারী ইউপি সদস্য অরুণা বালা আলো রানী।

গত ১৭ জুলাই সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যরা তাকে পশ্চিম বাইশারী গ্রামের প্রবেশ মুখ বাইশারী ব্রীজের কাছে গতিরোধ করে। তারা অরুণাবালা আলো রানীর কাছে ত্রিশ হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে না পারলে তার ননদদের একজনকে তাদের কাছে দিয়ে যেতে বলে। তার ব্যাগ হাতিয়ে রেখে দেয় নগদ পাঁচশ’ টাকা এবং কিছু জরুরী কাগজপত্র। ১৮ জুলাই খুব ভোরে অরুণা বালা আলো রানী প্রাণভয়ে চুপিসারে নৌকায় এলাকা ত্যাগ করে। তার ননদরাও চলে যায় বানারী পাড়া। বিষয়টি জানানো হয় বানারীপাড়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কান্তি পাল ও ওসি নাইমুর রহমানকে। কিন্তু জন কিংবা পুলিশ প্রশাসন এ ব্যাপারে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় সন্ত্রাসীরা আরো সাহসী হয়ে ওঠে। অরুণা বালা আলো রানী এখনও তার গ্রামে ফিরতে পারেননি। বাইশারীর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মধ্যে দক্ষিণ বাইশারীর শ্যামল চক্রবর্তীর পরিবার অত্যন্ত সম্মানিত। শ্যামল চক্রবর্তী কলেজ শিক্ষক। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত। স্থানীয় ইউপি আওয়ামী লীগের সম্পাদক। একাত্তরে দেশমাতৃকার জন্য লড়াই করেছেন অস্ত্র হাতে। সজ্জন এ মানুষটি দলমত নির্বিশেষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। শ্যামল চক্রবর্তীও রেহাই পেলেন না। তার দোষ তিনি দুটি জাতীয় পত্রিকার সংবাদ কর্মীর কাছে এখানকার ১৩ জুলাই’র সন্ত্রাস পরবর্তী প্রসঙ্গে কথা বলেছিলেন। তিনি সংবাদ কর্মীদের জানিয়েছিলেন, ১৩ জুলাই’র পর থেকে এখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায় খুব চাপের মধ্যে রয়েছে। তিনি নিজেও তাদের ভয়ে বেশ কিছুদিন ধরে বাড়ী থেকে বের হতে পারছেন না। তিনি কেন সংবাদকর্মীদের কাছে এ তথ্য জানিয়েছেন সেজন্য তাকে শাস্তি (!) দেয়া হয়। আমরা মঙ্গলবার দুপুরে তার বাড়ীতে যখন যাই, তখনও তিনি বাড়ী ছিলেন না। পুরোনো আমলের বিশাল বাড়ী। ডাকাডাকির পর তার স্ত্রী বের হয়ে আসেন। পরিচয় দিয়ে কথা বলার চেষ্টা করলে তিনি কেঁদে ফেলেন। বলেন, কি হবে এসব লিখে? আপনাদের সাথে কথা বলার কারণেইতো ওনাকে এসব ঝামেলা পোহাতে হলো।’ তিনি কিছুই বলতে রাজী হলেন না। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেলো, শ্যামল চক্রবর্তীর বাড়ীতে পাঁচই আগস্ট দুপুর আড়াইটায় হামলা করে বিএনপির সন্ত্রাসীরা। সন্ত্রাসীরা তাকে মারধর শুরু করলে তার স্ত্রী এসে বাঁচাতে চেষ্টা করেন। দুজনকেই তারা মারধর করে। সন্ত্রাসীরা শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয়নি ঐ বাড়ী থেকে লুটপাট করে মূল্যবান স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য মালামাল। শ্যামল চক্রবর্তী জখম অবস্থায় প্রাণভয়ে চিকিৎসার জন্য বের হতে সাহস পর্যন্ত করেননি। কয়েকদিন পর তিনি বরিশাল চলে যান চিকিৎসার জন্য। তারপর আর বাড়ী ফেরেননি। যারা ঐ বাড়ীতে হামলা করেছে তারা বিএনপির কর্মী নয় বলে স্থানীয় বিএনপি’র নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক নেতা দাবী করেছেন। তিনি জানান, হামলাকারীরা পেশাদার সন্ত্রাসী। তবে তিনি স্বীকার করেন স্থানীয় বিএনপির কেউ হয়তো তাদের এ ঘটনা ঘটাবার জন্য ব্যবহার করে থাকতে পারে। অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, হামলাকারীরা বিএনপির কোন কমিটিতে না থাকলেও তাদের সভা-সমাবেশের নেতৃত্বে থাকে। এ ঘটনায় আতঙ্ক আরো তীব্র আকার ধারণ করেছে। দক্ষিণ বাইশারীর পল্লী চিকিৎসক সুজিত কুমার দাসকে শুধুমাত্র সংখালঘু হবার অপরাধে (!) বেধড়ক মারধর করে। ছিনিয়ে নিয়ে যায় গলার চেইন, ঘড়ি ও টাকা-পয়সা। পশ্চিম বাইশারীর দুলাল মিস্ত্রি এলাকার নিরীহ মানুষ হিসেবে পরিচিত। তাকে বিএনপির এক সন্ত্রাসী মারধর করলো অকারণে। যে সন্ত্রাসী মারধর করেছে তার বক্তব্য ছিলো গেল নির্বাচনের সময়ে তার বাড়িতে যে দা ছিলো তা কেন সে পুলিশকে বলেছিলো। নিরীহ দুলাল মিস্ত্রি মার খেয়ে নীরবে বাড়ী চলে যায়। আশ্চর্যের বিষয় কেউ সন্ত্রাসীদের নাম পর্যন্ত বলতে চায় না। স্কুল ছাত্র শুকলাল ঘরামী স্কুল থেকে ফেরার পথে অকারণে মার খেলো এদের হাতে। মারধর করা হলো বঙ্কিম মুহূরীকে। ডুমুরিয়ার ব্যাপারী পদবীর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানান, তিনি একমাত্র ইউপি নির্বাচন ছাড়া আর কোনো নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি। সেটাও সম্ভব হয়েছে মাদারীবাড়ী কেন্দ্র হওয়ায়। বাইশারী কেন্দ্রে সে প্রকাশ্যেই বিএনপি প্রার্থীকে ভোট দেয়। ভোট দিয়ে সে গ্রামের সংখ্যালঘু ভোটারদের নিয়ে কেন্দ্রে আসার সময়ে বিএনপি’র ক্যাডাররাই তাকে বেধড়ক মারধর করে। ফলে যারা ভোট কেন্দ্রে রওনা হয়েছিল তারা প্রাণভয়ে বাড়ীতে ফিরে আসে। পশ্চিম বাইশারীর হালদার পদবীর একজন বলেন, ’৯৬’র নির্বাচনে সকালে কেন্দ্রে গেলে পরে বিএনপির লোকেরা আমারে ধানের শীষ দেখাইয়া ভোট দিতে বলে।’ ডুমুরিয়ার চ্যাটার্জী পদবীর আরেকজন জানান, তিনি গত দুটি জাতীয় নির্বাচনের একটিতেও ভোট দিতে পারেননি। গত নির্বাচনের দিন বাড়ী থেকে বের হতে পারেনি। তিনি আরো জানান, নির্বাচনের সময়ে গ্রামে সন্ত্রাসীরা রাতে এসে কেন্দ্রে যেতে না করে। তাছাড়া নির্বাচনের কয়েকদিন আগে থেকেই বোমাবাজী করে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। পশ্চিম বাইশারী ও ডুমুরিয়ায় প্রায় দেড় হাজার সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছে। দত্তপাড়া গ্রামেও আওয়ামী লীগ ক্ষমতা ছাড়ার পর সন্ত্রাস চলছে। যাকে তাকে মারধর করা হচ্ছে। বানারীপাড়া বাজারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যবসায়ী আমাদের জানান, খাবার আনার জন্য প্রতিদিন এক কর্মচারী তার বাড়িতে যায়। তাকে পর্যন্ত মারধর করা হয়েছে, হুমকি দেয়া হয়েছে। সেই কর্মচারী এখন আর দত্তপাড়া যেতে চায় না। সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে ঐ গ্রামের বেশ কিছু কিশোরীর স্কুলে যাওয়া বন্ধ ছিলো। কয়েকদিন আগে থেকে আবার দু’একজন করে যেতে শুরু করেছে।

সন্ত্রাসীদের ইচ্ছে অনুযায়ী ভোট না দিলে গ্রামে থাকতে দেবেনা বলে হুমকি দেয়া হয়েছে। এ গ্রামের ত্রিনাথ, অসীম, সুমন এদের তাণ্ডবের কারণে এখন গ্রাম ছেড়ে বানারীপাড়া উপজেলা সদরে আশ্রয় নিয়েছে। সম্প্রতি এ গ্রামের দিলীপ ঠাকুর, গোপাল ঠাকুরের কাছে এই সন্ত্রাসীরা ১০ হাজার টাকা করে চাঁদা দাবী করেছে।

এদের কয়েকজন কয়েকদিন আগে কালীবাড়ীর মনসা মন্দিরের লোহা কাঠের চৌকাঠ খুলে নিয়ে গেছে। এছাড়া যেসব সংখ্যালঘু পরিবার গ্রামের বাইরে থাকে তাদের বাড়ীর নানা জিনিসপত্র এরা নিয়ে যাচ্ছে। ৯১’র নির্বাচনে এ গ্রামে সংখ্যালঘু ভোটার ছিলো প্রায় চারশ’ কিন্তু এখন এর অর্ধেক ভোটারও নেই। বহু পরিবার ইতোমধ্যে এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে।

অভিযোগ করা হয়েছে, সন্ত্রাসীরা বলে দিয়েছে যে, ধানের শীষে ভোট না দিলে গ্রামে থাকতে দেবো না। বহু পরিবার ইতোমধ্যে এলাকা ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। এ পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রশাসনও অবহিত রয়েছে। তবে তারা কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ১০ সেপ্টেম্বর ২০০১

কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন

মন্তব্য করুন