নির্বাচনের পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, শারীরক নির্যাতন, শালীনতাহানি, প্রতিমা ভাঙচুরের মতো ঘটনাগুলো ধামাচাপা দেওয়ার জন্য একটা মহল সমন্বিত কৌশল অবলম্বন করছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে, যারা নির্যাতিত হয়েছেন তাদের ওপর হুমকি-ধমকি ও আরো নির্যাতনের ভয় দেখিয়ে বলতে বাধ্য করা যে, তাদের ওপর কোনো নির্যাতন হয়নি। আর কাগজে কলমে এসব সিদ্ধ করতে প্রশাসনের একশ্রেণীর কর্মকতাও বেশ তৎপর। রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার বুজরুক কোলা গ্রাম এবং ফরিদপুরের বিভিন্ন উপজেলায় হামলা ও নির্যাতন-পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনা পর্যালোচনা করে সচেতন মহল এমনটিই মনে করছে। রাজশাহী প্রতিনিধি ঃ জানান, সংখ্যালঘু নিপীড়নের ঘটনাগুলোর ব্যাপারে সর্বশেষ অনুসন্ধানে জানা গেছে, সরকারিভাবে তদন্ত করার পর প্রতিটি ঘটনাকে ‘মিথ্যা’, ‘সত্য নহে’,‘আদৌ ঘটেনি’ প্রভৃতি শব্দে মিথ্যা প্রমাণ করা হয়েছে এবং হচ্ছে। প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে প্রশাসনের এই তৎপরতাকে সর্বতোভাবে সহায়তা দিচ্ছে ক্ষমতাসীন বিএনপির স্থানীয় নেতারা। বাঘা উপজেলার নারায়ণপুর বাজারের পালপাড়ায় সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালিয়ে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয় গত ২ আগস্ট। বাঘার মণিগ্রাম, বিনোদপুর, আড়ানীতে একই গোষ্ঠীর লোকজন হিন্দুদের মন্দিরে হামলা করে। এসব ঘটনায় বাঘা থানায় তিনটি মামলা হলেও পুলিশ একজন হামলাকারীকেও চিহ্নিত করতে পারেনি। পালপাড়ার ক্ষতিগ্রস্থ প্রায় ২৫টি পরিবারকে সরকারি সহায়তা প্রদানের আশ্বাস দিয়েছিলেন ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাওয়া জেলার ডিসি ও এসপি। আজ অবধি ক্ষতিগ্রস্থরা প্রতিশ্রুতি সাহায্য পাননি। মামলাগুলোর সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঘা থানার এক দারোগা জানান, ওগুলো ফাইনাল রিপোর্ট দেওয়ার জন্য চাপ আছে। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বলেছেন, মামলাগুলো কী অবস্থায় আছে, আমি জানি না। ক্ষতিগ্রস্থরা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, দিনের আলোতে একদল চিহ্নিত লোক পুলিশের বাধা ভেঙ্গে পালপাড়ায় ঢুকে তাণ্ডব চালিয়েছে। অথচ পুলিশ কিছুই করছে না। নির্বাচনে পরদিন গোদাগাড়ীর বাসুদেবপুর ইউনিয়নের একটি গ্রামের সংখ্যালঘুদের ওপর চড়াও হয় নীয় বিএনপির ও জামায়াতের একদল কর্মী। ওই দিনই সংখ্যালঘুদের পক্ষে গোদাগাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরী করা হয়। পরবর্তী সময়ে জেলার তানোরেও ঘটেছে একই ধরনের ঘটনা। গোদাগাড়ী বাংধারা গ্রামের ১৯টি আদিবাসী পরিবারকে উচ্ছেদের অপচেষ্টা নেওয়া হচ্ছে বলে গত ১২ অক্টোবর আতঙ্কগ্রস্থ আদিবাসীরা অভিযোগ করেন ইউএনও ও থানার ওসির কাছে। কিন্তু মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে গত ১৬ অক্টোবর বাংধারার আদিবাসীরাই লিখিত দেয় স্থানীয় প্রশাসনের কাছে যে, তাদের কেউ হুমকি দিচ্ছে না বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে না। মজার ব্যাপার হলো, একই পত্রে তারা বলছেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের লোকজন তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের জন্য হুমকি দিচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় গোদাগাড়ীতে একটি সংবাদ সম্মেলনও করানো হয় গত ১৬ অক্টোবর। অন্যদিকে বাগমারার বুজরুক কোলা গ্রামের সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ অজিত কুমার নিজে বাদী হয়ে বাগমারা থানায় একটি মামলা করেছেন। অজিত এজাহারে ৪০ জনের নাম উল্লেখসহ দাবি করেছেন দুষ্কৃতকারীরা তাদের বাড়িঘরে হামলা ও পুকুরের মাছ লুট করে। ওই দিনই বাগমারা থানা বিএনপির এক নেতা রাজশাহীতে সাংবাদিকদের কাছে জনৈক প্রশান্ত কুমার স্বাক্ষরিত একটি বিবৃতিপত্র বিতরণ করেন, যাতে অজিতের স্বাক্ষর ছিল। বিবৃতিতে ক্ষতিগ্রস্থ সংখ্যালঘুসহ অন্যান্যরা দাবি করেন, বুজরুক কোলা গ্রামে কোনো হামলা হয়নি, কেউ আহত হয়নি প্রভৃতি। এই আলোচিত বিবৃতিটির একটি কপি প্রথম আলোর ঢাকা অফিসে প্রেরণ করা হয়, রাজশাহীর পুলিশ সুপারের ফ্যাক্স নম্বর থেকে। অনুসন্ধানে জানা গেছে বাগমারার ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর একাধিক সদস্য জানায়, সংবাদপত্রে খবর প্রকাশের পর সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন চড়াও হয়। বিএনপির লোকজন তাদের কাছ থেকে সাদা কাগজে সই- স্বাক্ষর নেয়। ক্ষতিগ্রস্তরা ক্ষোভের সঙ্গে বলেছেন, কী কারণে তাদের স্বাক্ষর নেওয়া হচ্ছে, তা তাদেরকে বলা হয়নি। সংগৃহীত স্বাক্ষরের সঙ্গে মনগড়া বিবৃতি ও বর্ণনা তৈরি করে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঢাকায় স্বরাষ্ট্র ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে প্রেরণ করেছেন। রাজশাহীতে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যতগুলো ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর প্রতিটির ক্ষেত্রেই প্রশাসন একই ধরনের কৌশল খাটিয়েছে। অবশ্য স্থানীয়ভাবে চাপ প্রয়োগ করে ঘটনার বিপরীতে বিবৃতি দিতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। প্রশাসন শুধুমাত্র ঘটনা চাপাই দিচ্ছে না, বুজরুক কোলার ঘটনার অন্যতম হোতা মুকুল নামের একজনকে গ্রেপ্তার করে পরের দিন তাকে ছেড়েও দিয়েছে। জানা গেছে, মুকুল অজিতের দায়ের করা মামলার এজহারভুক্ত আসামি। মুকুলকে ছেড়ে দেওয়া প্রসঙ্গে বাগমারা থানার ডিউটি অফিসার জানান যখন মুকুলকে ধরা হয় ওই সময় মামলাটি থানায় রেকর্ড হয়নি। জানা গেছে, অজিতের অভিযোগটি ঘটনার দিনই থানায় (১৩ অক্টোবর) জমা হয়েছিল। ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের ওপর হামলার অভিযোগ করছে, পরক্ষণেই আবার পুলিশের কাছে কিছুই হয়নি বলে বিবৃতি দিচ্ছে, এটা কেমন করে হচ্ছে? এ প্রশ্নের জবাবে একাধিক ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এন সি শর্মা প্রথম আলোকে বলেন, তারা পুলিশকে লিখিতভাবে বলেছে, কোথাও কোনো হামলা বা হুমকির ঘটনা ঘটেনি। সাংবাদিকরাই বাড়িয়ে প্রকাশ করছে বলে তিনি দাবি করেন। ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার বোয়ালমারী উপজেলার উত্তর হামাসদিয়া গ্রামের সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা লুটপাটের ঘটনার পর একটি প্রভাবশালী মহল গত ১১ অক্টোবর নির্যাতিত পরিবারগুলোর প্রধানদের কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করে যে, ‘তাদের ওপর কোনো নির্যাতন করা হয়নি।’ গত ৬ অক্টোবর রাতে ফরিদপুর বাসস্ট্যান্ডে পূজামণ্ডপে দুর্গাপ্রতিমা ভাঙচুর হয়। ঘটনাটি পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ায় একটি প্রভাবশালী মহল গত ১২ অক্টোবর ফরিদপুর প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা অস্বীকার করে। ওই সংবাদ সম্মেলনে এলাকার কয়েকজন সংখ্যালঘুকে নিয়ে এসে প্রতিমা ভাঙচুরের কথা অস্বীকার করানো হয়। এদের মধ্যে একজন পরে সাংবাদিকদের জানান, চাপে পড়ে সে সংবাদ সম্মেলনে আসতে বাধ্য হয়েছে । নগরকান্দা উপজেলার মানিকদী গ্রামের কলেজশিক্ষক রণজিত মণ্ডলের বাড়িতে হামলা চালিয়ে সন্ত্রাসীরা ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট করে। এই ঘটনায় গ্রেপ্তার হয় নয়জন। এছাড়া নগরকান্দার দক্ষিণ ফুলসুতি, ফুলবাড়িয়া, দফা, চৌমুখা, বাউতিপাড়াসহ বিভিন্ন গ্রামের সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা, লুটপাট, মারধর ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটেছে। অনেকে ভয়ে ফরিদপুর শহর ও পার্শ্ববর্তী গোপালগঞ্জে আশ্রয় নেন। কিন্তু গত ১৩ অক্টোবর নগরকান্দা উপজেলা হিন্দু কল্যাণ সমিতির সভাপতি ননী গোপাল বিশ্বাস, সাধারণ সম্পাদক বিপুল কুমার রায় এবং তালমা সর্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটির সভাপতি তপন কুমার ত্রিবেদীকে দিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে, নগরকান্দায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি নষ্ট হওয়ার কোনো ঘটনা ঘটেনি। গত ৬ অক্টোবর ভাঙ্গা উপজেলার আজিমনগর গ্রামে এক সংখ্যালঘু বাড়িতে হামলা চালিয়ে দুর্বৃত্তরা মায়ের সামনেই মেয়ের শালীনতাহানি করে। এলাকার লোকজন বলছে, প্রভাবশালীদের চাপ এবং অবিবাহিত মেয়ের ভবিষৎ চিন্তা করেই তারা এখন ঘটনা অস্বীকার করছে।

প্রথম আলো, ১৯ অক্টোবর ২০০১

মন্তব্য করুন