নির্বাচনের দিন সংখ্যালঘুদের ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে বিক্ষিপ্ত কয়েকটি আসনে নয়, দেশব্যাপীই পরিকল্পিতভাবে নানা সন্ত্রাসী অপতৎপরতা শুরু হয়েছে। দেশে কোন নির্বাচনে আর কখনও এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়নি। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৩৭টি জেলার কমপক্ষে ৯০টি আসনে সংখ্যালঘুদের জীবন নিরাপত্তাহীন করে তুলতে সব রকমের কলাকৌশল প্রয়োগ করা হচ্ছে বলে সংবাদদাতারা জানাচ্ছেন। স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী ও ধর্মান্ধ অপশক্তি বিশেষভাবে সারা দেশে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভীতি ও আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

সংবাদদাতারা জানান, বাড়িঘরে হামলা, শারীরিকভাবে লাঞ্ছনা, লুটপাট, চাঁদাবাজিসহ নানা ধরনের নিপীড়ন চালিয়ে এ আসনগুলোর সর্বত্রই এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে যাতে সংখ্যালঘুরা ভোট দিতে যেতে সাহস না পান, আর ভোট দিতে গেলেও যাতে ভোট না দিতে পারেন। সন্ত্রাসীদের নির্দেশিত প্রতীকে ভোট না দিলে ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই বলে প্রায় সর্বত্র ভোটারের বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেয়া হচ্ছে। কয়েকটি আসন থেকে আতঙ্কিত সংখ্যালঘু ভোটাররা বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। নিরাপদে ও নিশ্চিন্তে ভোট দিতে যাওয়ার ব্যবস্থা করার জন্য বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি আহ্বানও জানানো হয়েছে। যেসব আসনে সংখ্যালঘু ভোটার বেশি সেসব স্থানে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিলে সংখ্যালঘুদের ভোট দেয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়বে বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।

উল্লেখ্য, দেশের নির্বাচনে সংখ্যালঘু ভোটাররা ৩শ’ আসনের মধ্যে প্রায় ১শ’ আসনে প্রার্থীদের জয়-পরাজয় কমবেশি নির্ধারিত করে থাকেন। কয়েকটি আসনে সংখ্যালঘু প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে বিএনপির একজন ছাড়া বাকি নয় জন সদস্যই ছিলেন আওয়ামী লীগের। সংখ্যালঘু মোট ভোটারের সংখ্যা ‘৯৬-এর নির্বাচনের চেয়ে এবার প্রায় ১৮ লাখ বেড়ে প্রায় পৌনে এক কোটিতে পৌঁছেছে।

পর্যবেক্ষকদের ধারণা, ভোটার বেড়ে যাওয়াতে সাম্প্রদায়িক ও স্বাধীনতাবিরোধী দলগুলো শঙ্কিত হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া এ অপশক্তি ছলেবলে নির্বাচনে জয়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। সংখ্যালঘুদের ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলতে তারা বক্তৃতা-বক্তব্য দিচ্ছে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বক্তৃতা-বক্তব্য নির্বাচনী আচরণবিধিতে নিষিদ্ধ হলেও প্রশাসন বা নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে এখনও কোন পদক্ষেপ নেয়নি। একাত্তরে কুখ্যাত রাজাকার দেইল্যা ওরফে জামায়াতের দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর উস্কানিমূলক ক্যাসেট বাজানো হচ্ছে বহু স্থানে। বরিশাল ও খুলনা বিভাগের কয়েকটি আসনে জামায়াত সরাসরি সাম্প্রদায়িক বক্তব্য দিচ্ছে। খুলনা অফিস থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানান, এ অঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেয়া, হচ্ছে। কোথাও কোথাও এমনও বলা হচ্ছে⎯‘এবারের নির্বাচন হচ্ছে ধুতি আর টুপির লড়াই।’ বিভাগের অন্তত ২২টি আসনে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সাধারণ মানুষ খুবই ভীত ও উদ্বিগ্ন। খুলনা-৪ নির্বাচনী এলাকার রূপসা ও তেরখাদা উপজেলায় সংখ্যালঘু ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে সন্ত্রাসীরা তাদের মনোনীত প্রার্থীকে ভোট দেয়ার জন্য নির্দেশ দিচ্ছে। এ আসনের প্রায় ৩০ শতাংশ ভোটার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এ ভোটাররা যাতে নির্ভয়ে কেন্দ্রে না যেতে পারেন সে জন্য আতঙ্ক সৃষ্টি করা হচ্ছে। বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের হোগলাপাশা ও রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নে চলছে নীরব সন্ত্রাস। এখানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘দাড়িপাল্লা’ মার্কায় ভোট না দিলে ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার দরকার নেই বলে জানিয়ে দেয়া হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি চাঁদাও ধরা হচ্ছে।

পিরোজপুরের সদর ও নাজিরপুর নির্বাচনী এলাকায়ও একই হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান। সাঈদীর উস্কানিমূলক বক্তব্যের পর কয়েকটি এলাকায় হামলা হয়েছে। গত রবিবার রেখাখালি গ্রামে বিশ্বাস বাড়ি ও মিস্ত্রি বাড়িসহ কয়েকটি বাড়িতে হামলা হয়েছে। এ ঘটনার পর অনেকে প্রাণভয়ে এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছেন। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের কয়েকটি ইউনিয়নের সংখ্যালঘুদের ভোটদানে বিরত থাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে।

সংখ্যালঘু ভোটারদের হুমকি দেয়ায় পুলিশ দু‘জনকে আটক করলেও নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে বৃহত্তর যশোরে তাদেরকে ভয়ভীতি প্রদর্শন বেড়েই চলেছে। যশোরের ৮টি উপজেলার মধ্যে ৪টিতে সংখ্যালঘু ভোটার অনেক। মাগুরা ও নড়াইলেও তাই। এর মধ্যে নড়াইলের সদর, লোহাগড়া ও কালিয়াতে মোট ভোটারের যথাক্রমে ৩০, ২৫ ও ১৫ শতাংশ
হচ্ছে সংখ্যালঘু। মাগুরা ও নড়াইল থেকে গত নির্বাচনে দু’জন সংখ্যালঘু আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

রাউজান ও রাঙ্গুনিয়া নির্বাচনী এলাকায় সাকা ও গিকার সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ‘কষ্ট করে’ ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য বলে আসছে। ‘৯১ ও ‘৯৬র নির্বাচনে সন্ত্রাসীরা এটাই করেছিল। রাউজানে ৬৫ হাজার ও রাঙ্গুনিয়ায় ৫০ হাজার সংখ্যালঘু ভোটার রয়েছে। গত দু’নির্বাচনে ৯০% সংখ্যালঘু ভোট দিতে পারেননি। তাই এবার সন্ত্রাসীদের হুমকি-ধমকিতে তাঁরা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন।

ফেনী জেলার দাগনভূঞার বৈরাগীর বাজার এলাকায়ও সংখ্যালঘুদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হচ্ছে।

কুড়িগ্রাম-২ আসনে জাতীয় পার্টির (এ) প্রার্থীর সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘুদের নির্বাচনের পর দেখে নেয়া হবে’ বলে হুমকি দিচ্ছে। কুড়িগ্রাম শহরেও একটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত পাড়ায় জাপার (এ) প্রার্থীর সন্ত্রাসীরা চাঁদাবাজি ও কিছু কিশোরকে মারধর করেছে।

চাঁদপুর-১ আসনের কচুয়ার গ্রামে গ্রামে বিএপি প্রার্থীর সংখ্যালঘুদের ওপর সন্ত্রাসের নিন্দা করে বিবৃতি দিয়েছেন ঢাকাস্থ চাঁদপুর জেলা ফোরামের সভাপতি এমরান চৌধুরী। বেশি সংখ্যালঘু ভোটার যেসব আসনে রয়েছে সেগুলো হচ্ছে- দিনাজপুর-১, ২, ৪ ও ৬, নীলফামারী-২ ও ৩ রংপুর-২, কুড়িগ্রাম-২, গাইবান্ধা-৪ ও ৫, ঝিনাইদহ- ২ ও ৩ কুষ্টিয়া- ২ ও ৪, যশোর-১, ২ ও ৬, মাগুরা-১ ও ২, নড়াইল-১ ও ২, বাগেরহাট-১ ৩ ও ৪, খুলনা- ১, ২, ৩, ৪ ও ৫, সাতক্ষীরা-১, ২ ও ৩, ঝালকাঠি- ২, পিরোজপুর-১ ও ২, ময়মনসিংহ-১, ৩, ৪, ৫ ও ৯, নেত্রকোনা-১, ২, ৩, ও ৪, কিশোরগঞ্জ-৫ ও ৬, ঢাকা- ৭ ও ৮, নরসিংদী-১, নারায়ণগঞ্জ-৪ ও ৫, রাজবাড়ী-১ ও ২, ফরিদপুর-১, ২, ৩, ৪ ও ৫, গোপালগঞ্জ-১, ২ ও ৩, মাদারীপুর-১, ২, ও ৩, শরীয়তপুর-১, ২ ও ৩, সুনামগঞ্জ-১, ২ ও ৪, মৌলভীবাজার-৪, হবিগঞ্জ-১ ও ৬ ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৫ ও ৬, কুমিল−া-৫ ও ১০, চাঁদপুর-১ শেরপুর-১ ও ৩ এবং চট্টগ্রাম-৬ ও ৭।

দৈনিক জনকণ্ঠ, ২১ সেপ্টেম্বর ২০০১

কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন

মন্তব্য করুন