নির্বাচনকে ওরা ভয় পায়। অতীতেও পেয়েছে এখনও পাচ্ছে। এরা কোন রাজনৈতিক দল বা বিশেষ কোন দলের নেতা-কর্মী নয়। তবুও জন্মই ওদের আজন্ম পাপ। আর এ পাপবিদ্ধ মানুষগুলো হলো বানারীপাড়া উপজেলার বাইশারি ইউনিয়নের পশ্চিম বাইশারি, দক্ষিণ বাইশারি, দত্তপাড়া ও ডুমুরিয়া গ্রামের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা।

জাতীয় সংসদে বানারীপাড়া-স্বরূপকাঠি উপজেলা সমন্বয়ে গঠিত আসনে চারদলীয় প্রার্থী বিএনপি নেতা সৈয়দ শহীদুল হক জামাল। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে নিয়মিত পাকিস্তানি গানবোটে চলাফেরা করার সুবাদে তিনি এলাকায় বিশেষ পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর তিনি বিএনপি রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। এ আসনে ১৯৯১ সালে তিনি বিএনপি প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। আসন্ন নির্বাচনে তিনি একই আসনে চারদলীয় প্রার্থী হবেন। আর এ জন্যই তার অনুসারী সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘুদেরকে প্রতিপক্ষ ভেবে শুরু করেছে নির্যাতন। ইতোমধ্যে এলাকার বহু সংখ্যালঘু পরিবার গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছে। যাদের ঘরে বয়স্ক মেয়ে বা যুবক সন্তান আছে তাদেরকে অন্যত্র পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। এ সংখ্যালঘু পরিবারগুলো এখন সন্ত্রাসীদের চাঁদা দিতে দিতে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। অথচ ৫টি বছর এরা নির্বিবাদে জীবন নির্বাহ করছে।

বাইশারি ইউনিয়নের এ গ্রামগুলো ঘুরে বিচিত্র অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। অপরিচিত বিধায় কেউ-নিজেদের পরিচয়ও দিতে চায় না। বহু বুঝিয়ে তাদের কাছে নির্যাতনের বিবরণ জানতে চাইলে তারা লোমহর্ষক নির্যাতনের কাহিনীর বর্ণনা দেন; কিন্তু কেউ চান না, তাদের নাম সংবাদপত্রে প্রকাশিত হোক। চারদলীয় প্রার্থী সৈয়দ হক জামালের বাড়ি বাইশারি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা ত্যাগ করার পরপরই হিন্দু ধর্মাবলম্বী অধ্যুষিত ৪টি গ্রামে শুরু হয়েছে বিএনপি সন্ত্রাসীদের নির্যাতন। বিচ্ছু বাহিনী হিসেবে পরিচিত এ বাহিনী সংখ্যালঘুদেরকে নিয়মিত মারধর, বিভিন্ন ধরনের হুমকি, চাঁদাবাজি করে আসছে। জানা যায়, স্থানীয় বিএনপি নেতা ও ইটের ভাটার মালিক খালেক মৃধা হলো বিচ্ছু বাহিনীর গডফাদার। খালেক মৃধার ছেলে মিন্টু হলো দলনেতা। গত ১৭ই জুলাই তারা ইউপি সদস্য আলো রাণীর পথরোধ করে ত্রিশ হাজার টাকা চাঁদা বা একজন অবিবাহিত ননদকে চায়। তারা আলো রাণীর  ৪৫ ৪৬ ২৩ হাতব্যাগ হাতিয়ে ৫শ’ টাকা, জরুরী কাগজপত্র ছিনিয়ে নেয়। ১৮ জুলাই আলো রাণী ও তার ননদরা এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। পুলিশকে জানিয়েও কোন ফল পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত কলেজ শিক্ষক শ্যামল চক্রবর্তী ও তার স্ত্রীর ওপর হামলা চালিয়েছে বিএনপির সন্ত্রাসীরা। ৫ই আগস্টের হামলার পর তিনি সপরিবারে এলাকা ছেড়ে চলে যান। দক্ষিণ বাইশারি গ্রামের পল্লী চিকিৎসক সুজিত কুমার, পশ্চিম বাইশারি গ্রামের দুলাল মিস্ত্রি, স্কুল ছাত্র শুকলাল ঘরামি, বংকিম মুহুরীসহ অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকার, অথচ এরা কেউ আওয়ামী লীগের সদস্য বা কর্মী নয়। ডুমুরিয়া গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেপারি পদবির এক ব্যক্তি জানান, তিনি ইউপি নির্বাচন ছাড়া আর কোন নির্বাচনে ভোট দেন না। তিনি জানান, তার গ্রামের নিরঞ্জন বেপারি গতবার প্রকাশ্যে ধানের শীষে ভোট দিয়েও রেহাই পাননি। বিএনপি প্রার্থীর সমর্থকরা তারপরেও তাকে মারধর করেছে। ডুমুরিয়ায় চ্যাটার্জী পদবির এক ব্যক্তি জানান, গত নির্বাচনের দিন তাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেয়া হয়নি। পশ্চিম বাইশারি গ্রামের হালদার জানান, গত নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রে তাকে অনুসরণ করা হয়, যাতে তিনি ধানের শীষ ব্যতীত অন্য কোথাও ভোট দিতে না পারেন।

সংখ্যালঘুদের ভোট প্রদানে বাধা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন বলে কয়েকজনকে আশ্বস্ত করা হলেও তারা বলেন, সরকার থাকেন ঢাকায়। আর তারা থাকে গ্রামে। তাই তাদের দেখার কেউ নেই। এ অবস্থায় তারা আগামী নির্বাচনে ভোট না দেয়াই শ্রেয় বলে মনে করছেন। উল্লেখ্য, সর্বত্র ভোটার সংখ্যা বাড়লেও এখানকার চিত্রটি ভিন্ন। ১৯৯১ সালে এখানে সংখ্যালঘু পরিবারের প্রায় ৪শ’ ভোটার ছিল। এখন সেখানে তার অর্ধেক ভোটার নেই।

সংবাদ, ২৪ আগস্ট ২০০১

কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন

মন্তব্য করুন