ভোলার বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনোত্তর সহিংসতার ঘটনা এখনও অব্যাহত রয়েছে। পুলিশের সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তারা বলেন, এসবই গুজব। নির্বাচনোত্তর সহিংসতার ঘটনা প্রতিরোধে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা সংখ্যালঘুদের গভীর হতাশায় নিমজ্জিত করেছে। কেবল ভোলা সদর থানাতেই সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক বাড়িঘর লুটপাট হয়েছে। সমস্ত জেলায় প্রায় ৫’শ হিন্দু পরিবারের বাড়িঘর লুট হয়েছে। অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটেছে প্রচুর। অথচ প্রশাসনের কাছে এর কোন সঠিক খবর নেই। তাদের (পুলিশ) বক্তব্য যারা ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তারা কোন মামলা দায়ের না করলে আমাদের কিছুই করণীয় নেই।
ভোলা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নূরনবী জানান, সদর থানার বাংলা বাজারে সাবেক শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমদের ভাগ্নে শফিকের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ছাড়া আর কোন অগ্নিসংযোগের ঘটনা সর্ম্পকে তার জানা নেই। ঐ ঘটনা ঘটে গত ৫ অক্টোবর। উল্লেখযোগ্য কোন ভাংচুর বা লুটপাটের খবরও ভোলা থানায় নেই বলে ওসি নূরনবী ১০ অক্টোবর দুপুরে এই প্রতিনিধিকে জানান। অথচ ৬ অক্টোবর ভোলা শহর সংলগ্ন আলী নগর ইউনিয়নের ঠাকুর বাড়ির পঙ্কজ কুমার চক্রবর্তীর ঘরটি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, সে সম্পর্কেও ওসি সাহেব জানেন না।
ভোলা শহর থেকে ৪/৫ কি.মি দূরে উত্তর দিঘলদী ইউনিয়নের ৫৪টি বসতঘর লুটপাট হয়েছে নির্বাচনের পরের দিন। লুটপাট হওয়া এসব ঘরের মধ্যে ২টি মুসলিম পরিবার ছাড়া বাদবাকি ঘরগুলো হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের। ৪দলীয় জোটের নেতা-কর্মীদের নেতৃত্বে শতাধিক দুষ্কৃতকারী সারারাত ধরে এ লুটপাট চালায়। লুটপাটের সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বাড়িঘর ছেড়ে প্রাণের ভয়ে বাগানে বা পান বরজে গিয়ে আশ্রয় নেন। দুষ্কৃতকারীরা সেখানে গিয়ে হামলা চালিয়ে নারী নির্যাতন চালায়। উত্তর দিঘলদীর বাউল বাড়ির সুধীর বাউলের ৮০ বছরের বৃদ্ধ মা মাধুরানী লুটপাটের সময় বাড়ির অন্যদের মত ছুটে গিয়ে দূরে কোথাও পালাতে পারেননি। বাড়ির উঠানের কাছে গাছগাছালির আড়ালে লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু দুষ্কৃতকারীরা তাকে দেখে ফেলে। তারা বৃদ্ধা মাধুরানীর কাছে পরিবারের টাকা-পয়সা ও সোনার গহনা ইত্যাদি কোথায় আছে তা জানতে চায়। জানতে চায় তার ছেলে সুধীর ও অন্যরা কোথায় পালিয়েছে? কিন্তু মাধুরানী কিছুই বলতে না পারায় তারা বৃদ্ধা মাধুরানীকে বেদম মারধর করে পঙ্গু করে দিয়েছে। তিনি এখন শয্যাশায়ী। লুটপাট শেষ হয়ে যাবার পর এলাকায় সুকুমার দাস (৬০) আত্মগোপন অবস্থা থেকে যখন বাড়ি ফিরছিলেন, তখন পথে দুষ্কৃতকারীদের একটি গ্রুপের হাতে ধরা পড়ে যান। তারা সুকুমার দাসকে বেদম মারধর করে। তারা জানতে চায়, বাড়ির মহিলারা কোথায়? এলাকার সখিচরণ বাগমার জানান, দুষ্কৃতকারীরা অন্যদের মালামালের সাথে তার অতি জরুরী দলিলপত্রগুলোও নিয়ে গেছে। উত্তর দিঘলদীর সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবার পরেশ চন্দ্র হালদারের সুবৃহৎ টিনের ঘরটি ৪ দলীয় কর্মীরা মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে পরেশ চন্দ্র এখন ভোলা শহরে। তার ছেলে স্কুল শিক্ষক, তার ভাইয়ের ছেলে রত্নেশ্বর হালদার আওয়ামী লীগ করেন এবং সাবেক শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমদের বিভিন্ন সভায় রত্নেশ্বরকে দেখা গেছে এটাই তার অপরাধ। সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেয়ার অপরাধে উত্তর দিঘলদীতে হিন্দু পরিবারের কতিপয় মেয়েকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে মারপিটের শিকার হয়েছেন সাদেক খলিফার পুত্র ফরিদউদ্দিন ও তার স্ত্রী। ফরিদউদ্দিন জানান, ৮/১০ জন বিএনপি কর্মী তার ঘরে এসে হিন্দু মেয়েদের ছিনিয়ে নেবার চেষ্টা করে। কিন্তু নিতে পারেনি। এক সময়ের দুবাই প্রবাসী ফরিদউদ্দিন জানান, তিনি দুবাই থেকে অনেক সৌখিন জিনিস পত্র এনেছিলেন। কিন্তু দুষ্কৃতকারীরা মেয়েদের অপহরণ করতে না পেরে তার সেসব সামগ্রী নিয়ে যায়। হুমকি দিয়ে যায় ঘর থেকে হিন্দুদের তাড়িয়ে না দিলে তার ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হবে। বাধ্য হয়ে তিনি তার কাছে আশ্রিত মেয়েদের অন্যত্র সরিয়ে দেন।
সংবাদ, ১৩ অক্টোবর ২০০১