২০০১ সালে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর ব্যাপক নির্যাতন হয়েছে। এ নির্যাতনের শিকার হয়ে অনেকেই বাড়ি ঘর ছেড়ে অন্যত্র বসবাস করছে। কেউ আবার দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। এসব নির্যাতনের সাথে জড়িতদের গ্রেফতার পূর্বক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে প্রশাসন নীরব। প্রশাসনের এ নীরবতাকে দেশের সচেতন মহল রহস্যজনক বলে মনে করছে। তাদের মতে প্রশাসনের এ নীরব ভূমিকা সংশ্লিষ্ট সন্ত্রাসীদের উৎসাহিত করছে। ফলে ২০০২ সালেও দেশব্যাপী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন অব্যাহত থাকার সম্ভাবনা রয়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনের সংগৃহীত তথ্য এবং পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বাংলাদেশে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ২০০১ সালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ঘটনা সর্বকালের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। বিশেষ করে অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে, তা ’৭১-এ পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতাকেও হার মানিয়েছে। ২০০১ সালে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যে হামলা হয়েছে তাতে শত শত মানুষ হতাহত হয়েছে। হামলাকারীরা নির্বিচারে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বাড়িঘর ও মূল্যবান সম্পদ লুট করার পাশাপাশি অনেক মা-বোনকে ধর্ষণ করেছে। কোথাও কোথাও মা ও মেয়েকে একসাথে ধর্ষণ করা হয়েছে। কোথাও কোথাও একই মহিলা একাধিকবার ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এ মধ্যযুগীয় বর্বর ঘটনার শিকার হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানের হাজার সংখ্যালঘু পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। অনেকে প্রাণ ভয়ে দেশ ত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী হামলাকারীদের বেশির ভাগ ক্ষমতাসীন চার দলীয় ঐক্যজোটের কর্মী। তাদের মধ্যে জোটের নিয়ামক শক্তি বিএনপি এবং স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত-শিবির মৌলবাদী শক্তি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর পরিচালিত এ বর্বর হামলার নেতৃত্ব দেয়। ফলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও পুলিশ প্রশাসন এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সবচেয়ে বেশি নির্যাতন হয়েছে বরিশাল, বাগেরহাট, চট্টগ্রাম, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, রাজশাহী, পটুয়াখালী, নাটোর, ভোলা, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, ফেনী ও ঝিনাইদহ। বিশেষ করে গত ২ অক্টোবর থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত ভোলায় ১০০, পটুয়াখালী ৪০ ও বরিশালে ৪০, বাগেরহাটে ২০, সিরাজগঞ্জে ১৭ এবং যশোরে ১৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে নির্যাতনের শিকার হয়ে কুমিল্লার ১০ হাজার, নাটোরে ১২ হাজার, চট্টগ্রামে ৫ হাজার, ঝিনাইদহ ৫শ’, বগুড়ায় সাড়ে ৫শ’ এবং পাবনায় ৪শ’ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়েছে। এ সময়ে খুলনা ৩, নীলফামারী ২, ময়মনসিংহ ৯, জামালপুর ৩, চট্টগ্রাম ২, বগুড়া ২ ও কুমিল্লায় ২টি দুর্গা মূর্তি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন, মহিলা পরিষদসহ বিভিন্ন সংগঠন বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করে দেশব্যাপী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যে নির্যাতন হয়েছে তার তদন্ত করে। তাদের মতে, অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৫শ’ থেকে ১ হাজার মহিলা ধর্ষিত হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী গত ১১ অক্টোবর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে নির্বাচনোত্তর ৭৪টি সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এ সময়ে সিরাজগঞ্জ, বরিশালে, কুড়িগ্রাম ও ফেনীতে ৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভোলা, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহীতে ৪ জন নিহত হয়। এ সময়ে সারা দেশে ৪২টি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় মোট ৫৩টি মামলা হয়। পুলিশ ৫৯ জনকে গ্রেফতার করে । অথচ সরকারের পক্ষ থেকে দেশব্যাপী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর সংঘটিত ন্যাক্কারজনক ঘটনা অস্বীকার করে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) আলতাফ হোসেন চৌধুরী এ বিষয়ে সাংবাদিকদের তথ্য প্রদান না করে বাঁধা কথা বলেছেন। যা এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে সমর্থন করারই নামান্তর। এদিকে এসব ন্যাক্কারজনক ঘটনায় দেশের সচেতন মহলে মারাত্মক ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। বিভিন্ন ব্যক্তি এবং সংগঠন এসব বর্বর ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছে। অনেক সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন এসব ঘটনা সরেজমিনে তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত এর বিরুদ্ধে তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। উল্টো যারা এসব ঘটনায় প্রতিবাদ করেছে, নিন্দা জানিয়েছে, তাদেরকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার এবং সাম্প্রদায়িক ধুয়া তুলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার অভিযোগে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তারই শিকার হয়েছেন সাংবাদিক ও লেখক শাহরিয়ার কবির। তিনি দেশব্যাপী এ মধ্যযুগীয় বর্বর ঘটনার প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করার জন্য ভারতে যান। সেখান থেকে দেশে ফেরার পথে গত ২২ নবেম্বর তাকে জিয়া আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আটক করা হয়। প্রথমে তাকে ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪ ধারায় গ্রেফতার করা হয়। পরে তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা দায়ের করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হয়ে এবারের মহান বিজয় দিবস ও ইদুল ফিতর তাকে কারাগারে কাটাতে হয়। অথচ তিনি কোন অপরাধ করেননি। একজন সাংবাদিক হিসাবে এ ধরনের ন্যাক্কারজনক ও বর্বর ঘটনার বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ এবং তা জনসম্মুখে প্রকাশ ও এ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা তার দায়িত্ব ও কর্তব্য এটা কোন রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ড নয়। বিষয়টিকে সরকার নেতিবাচক দিক থেকে বিবেচনা করে তাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলায় জড়িয়েছে বলে সচেতন মহলের ধারণা। সচেতন মহলের মতে, শাহরিয়ার কবির দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের যে প্রামাণ্য চিত্র তৈরি করেছেন তা টেলিভিশনে প্রচার করা হলে আসল সত্য বেরিয়ে আসবে। এতে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হতে পারে। কারণ হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান জাতিধর্ম নির্বিশেষে আমরা সকলে এ দেশের নাগরিক। নাগরিক হিসাবে প্রত্যেক মানুষ তার নিজের পছন্দমত প্রার্থীকে ভোট দিবে- এটা তার সাংবিধানিক অধিকার। অথচ একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলকে ভোট দেয়ার অভিযোগে দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যে নির্যাতন নেমে এসেছে, তা কেবল সংবিধানের উপর আঘাত নয়, গণতন্ত্র ও মুক্তিযুদ্ধের পরিপন্থী।
দৈনিক রূপালী, ১ জানুয়ারি ২০০২