বাগেরহাটের উত্তরের সংখ্যালঘু অধ্যুষিত জনপদ চিতলমারীর গ্রামে গ্রামে জোটসন্ত্রাসীরা ওসামা বিন লাদেন ও লাশের ছবি সম্বলিত প্যাডে চিঠি পাঠিয়ে নতুন করে চাঁদাবাজি শুরু করেছে। এতে গ্রামের নিরীহ মানুষের মধ্যে ফের ছড়িয়ে পড়েছে আতঙ্ক। বিএনপির কথিত আঞ্চলিক কমিটির নামে চাঁদাবাজরা চালাচ্ছে নানা নির্যাতন। ক্ষুদ্ধ হলেও চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন খোদ বিএনপিরই অনেক নেতা। পুলিশী নিস্ক্রিয়তায় সন্ত্রাসীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে তারা মনে করেন। সারাদিন চিতলমারীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নানা পেশার মানুষের সাথে কথা বলে জানা গেছে, চাঁদা আদায়ের জন্য সন্ত্রাসীরা নয়া নয়া কৌশল প্রয়োগ করছে। বিন লাদেন ও এক মৃত মানুষের ছবি সংবলিত প্যাঁডে চিঠি দিয়ে এলাকার শিক্ষক-ব্যবসায়ী গৃহস্থদের কাছে বিভিন্ন অংকের চাঁদা দাবি করা হচ্ছে। বোয়ালিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মাখন লালের নিকট চিঠি দিয়ে দু’লাখ টাকা চাঁদা দাবি করা হয়েছে। বিকল্প হিসাবে দাবি করেছে তার মেয়েকে। এইচ.এস.সি পরীক্ষার্থিনী মেয়েকে তিনি অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছেন। চিঠিসহ থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন। প্রায় এক সপ্তাহ পরেও পুলিশ এ বিষয়ে কোন কিনারা করেনি। শতাধিক লোকের কাছে এরূপ চিঠি পৌছেছে। কিন্তু প্রাণ ভয়ে কেউ মুখ খুলতে চান না। এ উপজেলার বাখেরগঞ্জ বাজারে বিএনপির নামে কথিত আঞ্চলিক কমিটির অফিস খরচ বাবদ চাঁদা দাবিতে চালানো হচ্ছে নানা অত্যাচার। নির্ধারিত অংকের চাঁদার দাবি মেটাতে না পারায় চৌদ্দহাজারী গ্রামের রমেশ রাজবংশীর স্যালো মেশিনটি নিয়ে গেছে। ঐ গ্রামের ৩০টি জেলে পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে নানা অংকের চাঁদা। তালপাতা ও খড়কুটো ছাউনি দেওয়া জরাজীর্ণ একটি ঘর থেকে বিষ্ণু জেলে বেরিয়ে এসে বলেন, “আমি দেড় শ’ টাহা দিছি, তারপরও লাখফার আমার বউটার গায়ের লজ্জার জাগায় ( স্তন) হাত দেছে।” এ সময় বারান্দায় দাঁড়ানো বিষ্ণুর স্ত্রী ভাগ্নির (২৫) দু’চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরছিল। বিষ্ণুর বৃদ্ধা মা পারুল তখন গলা খেঁকিয়ে বলে ওঠেন, “… এ কৈয়ে আর কি হবে? তুই ঘরে আয়। উন্রা কোয়ানে কি আবার কবেয়ানে শেষে আরাক বিপদ।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ গ্রামের অনেকেই জানান, জনৈক লাখফার তালুকদার নাকি প্রায়ই একটি দা উঁচিয়ে বলে, “রক্তপাত কার কি করব? আমাগো নেতা হলো সেলিম ভাই। ভাই ১৮ খান দা দেছে⎯তার একখান পড়িছে আমার ভাগে। এইডের তো সদব্যবহার করতি হবে।” সুড়িগাতী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা রাখাল মেম্বার সন্ত্রাসীর ভয়ে বউ-ছেলে মেয়ে নিয়ে অন্যত্র পালিয়ে গেছেন। গত বিজয় দিবস ’৯৭ সালে সন্তোষপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দক্ষিণাঞ্চলের রাজাকার কমান্ডার রজ্জব আলী ফকিরের ভূমিকায় অভিনয় করার অপরাধে যাত্রাশিল্পী ডা. জগবন্ধু হালদারকে হত্যার হুমকি দিয়েছে জোট সন্ত্রাসীরা। তিনি আজ অব্দি নিরুদ্দেশ। বাখেরগঞ্জ বাজারে তার দোকান ও স’মিল দখল করার জন্য সন্ত্রাসীরা মরিয়া হয়ে উঠেছে বলে স্থানীয় কয়েকজন জানালেন। এই এলাকার সমরেশ, মৃণাল,বিবেকসহ অনেককেই সন্ত্রাসীরা হত্যার হুমকি দিয়ে মোটা অংকের চাঁদা দাবি করেছে। সুড়িগাতী, রায়গ্রাম, খিলিগাতী, ডুমুরিয়া ইত্যাদি এলাকার জেলেদের জাল আটকে আদায় করা হয় নানা অংকের চাঁদা। দেব, অতুল ও সুধীরসহ অনেক জেলে জানায়, টাকা দেয়ার পর এখন মাছ ধরতে পারছে। চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের কারণে দলের ভাবমূর্তি দারুণভাবে ক্ষুন্ন হচ্ছে স্বীকার করে চিতলমারীর কয়েকজন বিএনপি নেতা তাদের অসহায়ত্বের কথা জানান। তারা পুলিশের রহস্যজনক নীরবতায়ও ক্ষুদ্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

দৈনিক জনকন্ঠ, ৯ ডিসেম্বর ২০০১

মন্তব্য করুন