সাতক্ষীরার পারকুকরালি এলাকার হোমিও চিকিৎসক মোখলেছুর রহমান জনি সদর থানার লকআপ থেকে নিখোঁজের পাঁচ বছরেও সন্ধান মেলেনি। এ ঘটনায় হাইকোর্টের নির্দেশে মঙ্গলবার (১৭ আগস্ট) তার বাবা শেখ আব্দুর রাশেদ বাদী হয়ে ছেলেকে অপহরণের পর খুন করে লাশ গুমের অভিযোগ এনে সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে মামলা দায়ের করেছেন।

মামলায় সদর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এমদাদুল হক শেখ, এরপর বদলি হয়ে আসা ওসি ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও উপপরিদর্শক (এসআই) হিমেল হোসেনকে আসামি করা হয়েছে। বিচারক মো. হুমায়ুন কবীর মামলার কাগজপত্র পর্যালোচনা করে আদেশের জন্য বুধবার (১৮ আগস্ট) দিন ধার্য করেছেন।

মামলা ও ঘটনার বিবরণে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট রাত সাড়ে ৯টার দিকে অসুস্থ বাবার জন্য বাইসাইকেলে ওষুধ কিনতে গিয়ে সাতক্ষীরা শহরের লাবনী সিনেমা হলের সামনের একটি দোকান থেকে সদর থানার এসআই হিমেল শহরের পারকুকরালির মোখলেছুর রহমান জনিকে ধরে থানায় নিয়ে যায়।

এরপর টানা তিন দিন ৫, ৬ ও ৭ আগস্ট স্ত্রী জেসমিন নাহার রেশমা তার শ্বশুর ও স্বজনদের নিয়ে লকআপে তাকে খাবার দিয়ে এসেছিলেন। স্ত্রীর সঙ্গে কথাও বলেছিলেন এ চিকিৎসক। ওসি এমদাদুল হক শেখ ও এসআই হিমেলের সঙ্গে কথা বললে জনির ‘জঙ্গি সম্পৃক্ততা’ রয়েছে বলে জানানো হয়। স্বামীর মুক্তির বিনিময়ে তৎকালীন ওসি ও এসআই জনির স্ত্রী রেশমার কাছে দাবি করেন মোটা অঙ্কের টাকা।

তবে ৮ আগস্ট থানায় গেলে জনিকে পাওয়া যায়নি। পুলিশ জনির অবস্থান সম্পর্কে জানাতে পারেনি। বিষয়টি সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি, ক্ষমতাসীন দলের নেতা, মানবাধিকার কর্মী, জেলা প্রশাসক ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করা হয়। ওই বছরের ২৪ আগস্ট বিষয়টি জানানো হয় সাতক্ষীরা পুলিশ সুপারকে (এসপি)। ২৬ ডিসেম্বর থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করতে গেলে থানার ওসি ফিরোজ হোসেন মোল্লা তা গ্রহণ করেননি।

উপায় না দেখে ২০১৭ সালের ৩ জানুয়ারি সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেন রেশমা। ২১ জানুয়ারি আইন ও শালিস কেন্দ্রের তদন্তকারী টিমের সদস্য অনির্বান সাহা, মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাসহ কয়েকজন জনির বাড়িতে আসেন ও পরে থানায় যান। যা পরদিন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।

২০১৭ সালের ২ মার্চ হাইকোর্টে রিট পিটিশন (২৮৩৩/১৭) দাখিল করেন রেশমা। মামলায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আটজনকে বিবাদী করা হয়। আদালতের নির্দেশে ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ আদালতে উপস্থাপন করা এসপির ব্যাখ্যায় বলা হয়, নিখোঁজ মোখলেছুর রহমান নিষিদ্ধ সংগঠন ‘আল্লাহর দল’র সঙ্গে যুক্ত এবং তাকে গ্রেফতার করা হয়নি।

১৯ মার্চ শুনানি শেষে আদালত জনিকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে বিচারিক আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে ৯ মে এ সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ঢাকা লিগ্যাল সেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এএসএম জাভিদ হাসানকে নির্দেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী ১০ জন পুলিশ কর্মকর্তা-সদস্য ও পাঁচজন সাধারণ মানুষের জবানবন্দি নিয়ে মোখলেছুর রহমান জনিকে ২০১৬ সালের ৪ আগস্ট আটক করেনি বা তাকে কেউ থানার মধ্যে দেখেনি মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন।

পরে আদালতের নির্দেশে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই সাতক্ষীরার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম হাবিবুল্লাহ মাহমুদ হাইকোর্টে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে থানা লকআপ থেকে ডা. জনির নিখোঁজ হওয়ার সত্যতা উঠে আসে। পরবর্তী সময়ে এক আদেশে ওই বছরের ৩ অক্টোবরের মধ্যে এ সম্পর্কিত তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) নির্দেশ দেওয়া হয়।

পিবিআই তদন্ত প্রতিবেদনে ডা. জনিকে থানায় এনে আটক রাখার সত্যতা মেলেনি বলে উল্লেখ করা হয়। ২০১৮ সালের ২৪ জানুয়ারি তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা শেষে হাইকোর্ট জনি নিখোঁজ হওয়ার ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি নিয়ে তার তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নেওয়ার জন্য থানা ওসি এমদাদুল হক শেখ, ফিরোজ হোসেন মোল্লা ও এসআই হিমেল হোসেনের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা গ্রহণ একইসঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা যেতে পারে বলে এক আদেশে উল্লেখ করেন।

সে অনুযায়ী আইন ও শালিস কেন্দ্রের সহযোগিতায় জেসমিন নাহার রেশমা আদালতে মামলা করার প্রস্তুতি নিলে শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট আইনজীবী অপারগতা প্রকাশ করায় আর মামলা করা হয়নি। এর কয়েক মাস পর জেসমিনের অন্যত্র বিয়ে হওয়ায় হাইকোর্টে বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খন্দকার দিলিরুজ্জামানের আদালতে হাজির হয়ে ২৮৩৩/১৭ নং রিট পিটিশনে জনির বাবা শেখ আব্দুর রাশেদ নিজেকে বাদী শ্রেণিভুক্ত হওয়ার আবেদন করেন।

আদালত তা মঞ্জুর করলে শেখ আব্দুর রাশেদ মামলা করার জন্য সাতক্ষীরা জেলা আইনজীবী সমিতির তৎকালীন সভাপতি অ্যাড. এম শাহ আলম ও সাতক্ষীরা আদালতের লিগ্যাল এইডের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিচারক সালমা আক্তারের শরণাপন্ন হন। এরপরও কোনও আইনজীবী না পাওয়ায় তিনি মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অ্যাড. সুলতানা কামালের দ্বারস্থ হন।

এক পর্যায়ে তারই সহায়তায় সাতক্ষীরার জ্যেষ্ঠ আইনজীবী অ্যাড. মোসলেম উদ্দিন ও অ্যাড. মো. ফরহাদ হোসেনের মাধ্যমে মঙ্গলবার সাতক্ষীরার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে এ মামলা দায়ের করেন।

প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর এসআই হিমেলের বিরুদ্ধে সাতক্ষীরায় বিভাগীয় মামলা (৬/১৮) দায়ের করা হয়। এ ঘটনায় ২০১৮ সালের ১৮ নভেম্বর সাতক্ষীরার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইলতুৎ মিশের কাছে ও ২২ নভেম্বর খুলনার সহকারী পুলিশ সুপার আব্দুল কাদের বেগের কাছে জেসমিন নাহার রেশমা, তার শ্বশুর শেখ আব্দুর রাশেদ, শাশুড়ি আনোয়ারা খাতুন সাক্ষী দেন।

একইভাবে ২৮ নভেম্বর মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ ও তিন পুলিশ সদস্যের সাক্ষী গ্রহণ করা হয়। একই ঘটনায় ১৬/২০ ও ১৭/২০ বিভাগীয় মামলা হয় তৎকালীন ওসি এমদাদ শেখ ও ফিরোজ হোসেন মোল্লার বিরুদ্ধে। খুলনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ওয়াসিম ফিরোজ ২০২০ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে কয়েক দফায় সাতক্ষীরা আদালতের পুলিশ পরিদর্শকের কার্যালয়ে ও খুলনা নিজ কার্যালয়ে নিখোঁজ জনির বাবা, মা, বোন, চাচা, মানবাধিকার কর্মী রঘুনাথ খাঁ, সিপাহী ফসিয়ার রহমান, সিপাহী ইলিয়াস হোসেন, সিপাহী মহিদুল ইসলাম ও এসআই রইচউদ্দিনসহ ১৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন।

মামলার বাদী পক্ষের আইনজীবী মোসলেম উদ্দিন ও অ্যাড. ফরহাদ হোসেন বলেন, বুধবার (১৮ আগস্ট) আদালত এ মামলার আদেশ দেবেন।

বাংলা ট্রিবিউন

মন্তব্য করুন