কৃষি শ্রমিক প্রাণকৃষ্ণ (৪০) স্ত্রী ও দুই কন্যাকে নিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। এখন অপেক্ষা শুধু আমন ধান ওঠার। ক্ষেতের ধান উঠলেই তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে পাড়ি জমাবেন পার্শ্ববর্তী দেশে। ভূমিহীন ক্ষেতমজুর প্রাণকৃষ্ণের ভাষায়, ‘আমাদের ওপর যে অত্যাচার হয়েছে, তারপর এ দেশে আর কিভাবে থাকবো? এখানেও কাজ করে খেতে হবে, ভারতে গিয়েও কাজ করেই খাবো। সেখানে তো আর আমার বাড়ি ঘর লুটপাট হবে না।’ এবারে সংসদ নির্বাচনের পর সন্ত্রাসীরা দরিদ্র প্রাণকৃষ্ণের সহায়-সম্বল সব কেড়ে নিয়েছে। নির্বাচনের পরদিন ২ অক্টোবর ভোলা জেলার লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের অন্নদাপ্রসাদ গ্রামে সন্ত্রাসীদের আক্রমণের শিকার কয়েকশ হিন্দু পরিবারের মতো প্রাণকৃষ্ণও একজন। ওই ঘটনার সরেজমিন তথ্যানুসন্ধানে অন্নদাপ্রসাদ গ্রামে গিয়ে গত ৩১ অক্টোবর সেখানকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলাপকালে প্রাণকৃষ্ণের কন্ঠস্বরের প্রতিধ্বনি শোনা যায় যতীন্দ্র দাস, নারায়ণ চন্দ্র দাস, মরণ শীল ও দুর্যোধনের কন্ঠেও। ভুক্তভোগী এসব অসহায় গ্রামবাসী সন্ত্রাসীদের অত্যাচারে বাধ্য হয়ে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু এই দরিদ্র মানুষগুলোকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে ফসল তোলা পর্যন্ত। কারণ ক্ষেতের ফসল না উঠলে তাদের নগদ অর্থের সংস্থান হবে না। কিন্তু সন্ত্রাসীরা এ গ্রামে শুধু লুটপাট আর নারীদের সম্ভ্রমহানি করেই তাদের অপকর্মের ইতি টানেনি, এখন তারা গ্রামের অবস্থাপন্ন মানুষের পাশাপাশি অসহায় ক্ষেতমজুরদের কাছ থেকেও চাঁদা আদায় করছে। ভোলা জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে গত ৫ অক্টোবর এ গ্রামে একটি অস্থায়ী পুলিশ ফাঁড়ি বসানো হয়েছে। অথচ গত এক মাসেও কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীরা দিনে-দুপুরে হুমকি দিয়ে যাচ্ছে গ্রামবাসীদের। পুলিশের নাকের ডগাতেই ঘুরে বেড়াচ্ছে ধর্ষণ মামলার পলাতক আসামিরা। এ প্রতিবেদক যখন গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলছিল তখন একটি ধর্ষণ মামলার পলাতক আসামি স্থানীয় প্রভাবশালী ও চিহ্নিত সন্ত্রাসী ইয়াছিন মাস্টারের পুত্র বেলাল প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। তাকে দেখে আতঙ্কে কথা বলা বন্ধ হয়ে যায় অসহায় মানুষগুলোর। গ্রামবাসীরা জানান, অন্নদাপ্রসাদ গ্রামে হিন্দুদের নীরব দেশত্যাগ চলছে বহু আগে থেকেই। প্রায় ছয় কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই হিন্দু প্রধান বর্ধিষ্ণু গ্রামটিতে সবচেয়ে বড় আঘাত আসে ১৯৯১ সালে ভারতে বাবরি মসজিদ ভাঙার ঘটনার পর। একদল সুযোগ সন্ধানী চিহ্নিত সন্ত্রাসী তখন জ্বালিয়ে দেয় শত শত ঘরবাড়ি। লুটপাট করে সর্বস্বান্ত করে দেয় কয়েকশ হিন্দু পরিবারকে। তখন গ্রামের অর্ধেক হিন্দু পরিবার ভারতে চলে যায়। ১৯৯১ সালে লর্ড হার্ডিঞ্জ ইউনিয়নের হিন্দু ভোটারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭ হাজার। ২০০১ সালে এই ভোটারের সংখ্যা কমে প্রায় দুই হাজার ২০০-তে এসে দাঁড়িয়েছে বলে গ্রামবাসীরা জানান। ভোটের সংখ্যার এই ক্রমহ্রাসমান ধারাই গ্রামের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর দেশত্যাগের সাক্ষ্য দেয়। ১৯৯১ সালের আগে অন্নদাপ্রসাদ গ্রামে এধরনের কোনো হামলা হয়নি। কারণ স্থানীয় প্রভাবশালী ধনাঢ্য ব্যক্তি প্রিয়লাল প্রায় ১৭ বছর এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রিয়লাল আগলে রেখেছিলেন গ্রামের সহস্রাধিক হিন্দু পরিবারকে। বৃদ্ধ প্রিয়লাল যখন চলৎশক্তিহীন হয়ে পড়েন, তখনই সন্ত্রাসীরা এই গ্রামের ওপর চরম আঘাত হানে।’ ৯১-এর হাঙ্গামার সময় তারা প্রিয়লাল বাবুকে তুলে ধরে এনে তার বাড়ির সামনে বসিয়ে চোখের সামনে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে জালিয়ে দেয় তার ঘর। চোখের সামনে বসতভিটা জ্বলতে দেখে আর সহ্য করতে পারেননি তিনি। এই ঘটনার অল্প কিছু দিনের মাথায় তার মৃত্যু হয়। সে সময় সাত দিন ধরে গ্রামে আগুন জ্বললেও নেভানোর লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি। তখন গ্রামের প্রায় অর্ধেক লোক ভারতে চলে যায়। বর্তমানে এ গ্রামে প্রায় ৪০০ হিন্দু বাড়ি রয়েছে। এবারের নির্বাচনের পর সন্ত্রাসীরা গ্রামজুড়ে যে তাণ্ডব চালিয়েছে এর ফলে অনেক পরিবার ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। এদের মধ্যে আছেন খোকন দাস, নিত্যলাল, সুনীল, জগন্নাথসহ আরো অনেকে। এদের কারো পরিবারের কন্যা সম্ভ্রম হারিয়েছে, কেউবা সর্বস্ব খুইয়েছেন সন্ত্রাসীদের হাতে। ২ অক্টোবর হামলাকারী সন্ত্রাসীদের নাম সম্পর্কে গ্রামবাসীরা বলেন, পুলিশসহ জেলা প্রশাসনের কাছে এদের নাম ভালোভাবে জানা থাকা সত্ত্বেও কাউকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। এ ব্যাপারে ভোলা জেলা প্রশাসক কবির মো. আশরাফ আলমের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, লর্ড হার্ডিঞ্জে সন্ত্রাসী হামলার খবর পেয়ে তিনি সেখানে গিয়েছিলেন। এসব চিহ্নিত সন্ত্রাসীর নামও তিনি জানেন। কিন্তু গ্রামবাসীর মধ্যে কেউ ভয়ে সন্ত্রাসীদের নাম উল্লেখ বা থানায় কোনো মামলা দায়ের না করায় প্রশাসন এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি।

প্রথম আলো, ১০ নবেম্বর ২০০১

মন্তব্য করুন