দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন ও হুমকির অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত কয়েকদিনে সুজানগর, চাটমোহর, ভাঙ্গুরা, ফরিদপুর, শেরপুর, সাতক্ষীরা ও রাজবাড়ী জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা হয়েছে। অনেক প্রার্থীর সমর্থকরা নৌকায় ভোট না দেওয়ার জন্য তাদের হুমকি দিচ্ছে। এমনকি তাদের বাড়ি-ঘরে লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ পর্যন্ত করা হয়েছে। অনেকে ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে বলেও জানা যায়। এ বিষয়ে আমাদের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর।

পাবনা প্রতিনিধি গত বুধবার সুজানগরের বিভিন্ন এলাকা সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়,তাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। সন্ত্রাসীদের হুমকির কারণে অনেকের স্বাভাবিক জীবন বিঘ্নিত হচ্ছে।

সুজানগর, জোরপুকুরিয়া, কামারহাট, গোরিয়া, উদয়পুর, মালিফা, নিশ্চিন্তপুর, কুড়িবাড়ী, ভাটপাড়া, মানিকদী, নাজিরগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৪০ হাজার সংখ্যালঘুর বসবাস। এবার সংখ্যালঘুদের ২০ হাজার ভোট রয়েছে। গত ৪ সেপ্টেম্বর জোরপুকুরিয়া গ্রামে সংখ্যালঘুদের ওপর একদল সন্ত্রাসী হামলা চালায়। নারী-পুরুষসহ ২০ জন আহত হয়। গত ২০ সেপ্টেম্বর নিশ্চিন্তপুর গ্রামের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলায় প্রায় ৫০ জনের মতোআহত হয়। এছাড়া প্রায় ৩০টি বাড়িঘরে ব্যাপক হামলা ও লুটপাট হয়।

বর্তমানে সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘুদের ভোট না দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। যদি ভোট দেয় পরে দেখে নেওয়া হবে বলে হুমকি দিচ্ছে। সংখ্যালঘুদের হামলা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি পরস্পরকে দোষারোপ করেছে।

বিএনপির প্রার্থী সেলিম রেজা হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, এই এলাকার সংখ্যালঘুরা আমার সঙ্গে রয়েছে। সুতরাং তাদের ওপর বিএনপির হামলা সাজানো নাটক। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ও নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক সাইদুল হক চন্নু বলেন,বিএনপির সন্ত্রাসীরা সংখ্যালঘুদের ওপর একের পর এক হামলা চালাচ্ছে।

পাবনা-২ (চাটমোহর, ভঙ্গুরা, ফরিদপুর) আসনে সংখ্যালঘুদের মারপিট, ভয়ভীতি প্রদর্শনের ঘটনায় এলাকায় এক নীরব আতঙ্কাবস্থা বিরাজ করছে। গত বুধবার রাতে চাটমোহর উপজেলার গুনাইগাছা ইউনিয়নের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুজনকে মারপিট ও পাঁচটি মুদি দোকান ভাঙচুর করা হয়। আহতরা হলো দীলিপ দাসের পুত্র প্রদীপ দাস (২০) ও অমূল্য চূর্ণকারের ছেলে দুলার চূর্ণকার (৩০)। এ ঘটনার প্রতিবাদ করায় ডা. অঞ্জন ভট্টাচার্যসহ ওই এলাকার নেতৃস্থানীয় হিন্দুদের প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে চারদলীয় ঐক্যজোটের প্রার্থীরা নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য চাটমোহর পৌরসভার চেয়ারম্যান প্রফেসর আঃ মান্নান জানান, সংখ্যালঘুদের স্পর্শকাতরতাকে উসকে দিয়ে আওয়ামী লীগ জোটের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে।

শেরপুর প্রতিনিধি জানান শেরপুর জেলার তিনটি আসনের সংখ্যালঘুদের নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি প্রদান করার অভিযোগ উঠেছে। চারদলীয় ঐক্যজোট ও কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে এসব হুমকির অভিযোগ উঠেছে। শেরপুর-১ আসনের চরশ্রীপুর এলাকায় আদিবাসীদের আ.লীগের পক্ষে ভোট না দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।

শেরপুর-২ আসনে আ.লীগের প্রার্থী সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী অভিযোগ করে বলেন, নকলা এবং নালিতাবাড়ীতে সংখ্যালঘুদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিএনপি কর্মীরা নানা প্রকার ভয়ভীতি ও হুমকি-ধমকি দিচ্ছে।

এ ব্যাপারে শেরপুর-২ আসনের বিএনপির প্রার্থী জাহেদ আলী চৌধুরী সংখ্যালঘুদের হুমকি প্রদানের অভিযোগ অস্বীকার করেন।

নৌকা প্রতীকে ভোট দেবে এই অভিযোগে সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা নির্মল গাইনের বসতঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সরজমিনে গিয়ে জেলার আশাশুনি উপজেলার শ্রীধরপুর গ্রামের ৩ শতাধিক জেলে সম্প্রদায়ের পরিবারের মধ্যে চরম আতঙ্ক লক্ষ্য করা গেছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হুমকির মুখে গ্রামটির অর্ধশতাধিক নারী-পুরুষ এখন প্রাণ বাঁচাতে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। আশাশুনির মাধবী ও সুচিত্র জানায় ২৫ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার তখন রাত ৯টা। ২০/২৫ জনের সশস্ত্র একটা দল অতর্কিতে নির্মল গাইনের বাড়িতে হামলা করে। সন্ত্রাসীরা নির্মল গাইন ও তার স্ত্রী আশালতার শোবার ঘরে আগুন দেয়।

রাজবাড়ী-১ নির্বাচনী এলাকার চন্দনী খালগঞ্জ, বসন্ত পুর ও মিজানপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে চারদলীয় ঐক্যজোটের নেতা-কর্মীরা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে বলে রাজবাড়ী জেলা ১১ দলের নেতৃবৃন্দ অভিযোগ করেন। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টায় জেলা ১১ দলের নেতৃবৃন্দ সাংবাদিকদের বলেন বেশকিছু দিন যাবৎ চারদলীয় ঐক্যজোটের নির্বাচনী প্রচরাভিযানের সময় বসন্তপুর ইউনিয়নের মহারাজপুর চন্দনীর জেইকুডা, ধাওয়াপাড়া, খানগঞ্জের হাটবাড়িয়া ও মিজানপুর ইউনিয়নের দয়ালনগর গ্রামে সংখ্যালঘুদের ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত না হওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে।

আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নেত্রকোনার বিভিন্ন এলাকায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের অনেক অভিযোগ পাওয়া গেছে। আওয়ামী লীগ ও চার দলের দু-একজন প্রার্থী এবং থানা পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এ অভিযোগের সত্যতাও পাওয়া গেছে। দুর্গাপুর-কলমাকান্দা এলাকায় এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে।

এখানকার কুমুদগঞ্জ, রামনগর, ওজিরকোনা, চান্দা প্রভৃতি স্থানে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চলছে। তাদের ভোটকেন্দ্রে যেতে নিষেধ করা হচ্ছে। ধানের শীষ প্রতীকে ভোট দিতে অস্বীকৃতি জানালে প্রবীর, প্রফুল্ল ও বরীন নামের তিনজন যুবককে বেধড়ক মারপিট করা হয়েছে। পুলিশ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অপরাধে হায়দার নামের একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। গত বুধবার রাতে সদর উপজেলার সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এলাকা নয়নপুর গ্রামে এই ঘটনা ঘটে।

প্রথম আলো, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০০১

মন্তব্য করুন