২০ হাজার টাকা অনাদায়ে পরেশ হালদারের মাথা ধার্য করে দিয়েছে চাঁদাবাজরা। এ কথা যে শুধু কথার কথা নয়, তাই বোঝাতে পরেশ হালদারের বিরাট খড়ের পালাটি পুড়িয়ে দিয়েছে সন্ত্রাসীরা। পথঘাটে, হাটবাজারে লোকজন দিয়ে বলানো হচ্ছে, টাকাটা দিয়ে দেয়াই ভালো। জীবনের চাইতে টাকা তো বড় হলো না। ঘিওরের কুসুণ্ডা মাঝিপাড়ার পরেশ হালদার আর ছবি রানী হালদারের পরিবার এখন চাঁদাবাজদের তোপের মুখে। চাঁদাবাজরা নিজেদের পরিচয় দেয় বিএনপির লোক হিসেবে। এদের সঙ্গে যোগ হয়েছে শরীফ রাজাকার। এই শরীফ আবার এককাঠি সরেস। তার দৃষ্টি পড়েছে পরেশ হালদারের স্ত্রী ছবি রানী হালদারের ওপর। কুপ্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় সেও বলেছে আজ হোক কাল হোক ধরা দিতেই হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এই রাজাকার বাড়িতে তেমন আসত না। গত দেড়-দু মাস ধরে এখন বাড়িতেই থাকছে। কুসুণ্ডা মাঝিপাড়ার ৭/৮ ঘর হালদারদের মধ্যে পরেশই একমাত্র শিক্ষিত পরিবার। নিজে বিএ পাস। স্ত্রী ছবিও এসএসসি পাস। শিক্ষিত হলেও এরা নিজ পেশা ছাড়েনি। এখনও জাল ফেলে মাছ ধরে। সঙ্গে কৃষি কাজও করে। এসএসসি পাস ছবি রানী জমি বর্গা নিয়ে নিজেই জমি চাষ করে। চারটি গরু পালে। সে এনজিও ‘আশা’র সদস্য। এছাড়াও টুকটাক ব্যবসা করে। পরিশ্রমী মহিলা হিসেবে গ্রামে ছবির সুনাম সবাই করে। যার ফলে মাঝিপাড়ার মধ্যে এদেরই অবস্থা সবচাইতে ভালো। আর এটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের জন্য। ছবি রানীর সঙ্গে কথা হলো ঘিওরের ‘আশা’ অফিসে। পরেশের মতো অতটা অসহায় কিংবা ভীত মনে হলো না তাকে। সে বলল টাকা কি গাছের ফল। চাইলাম আর পাইড়া (পেড়ে) নিলাম। লেখাপড়া শিখে ও গায়ে খাইটা (খেটে) পোলাপান নিয়া বাইচা আছি। কষ্ট কইরা টাকা কামাই, জীবন থাকতে ওই টাকা চান্দা (চাঁদা) দিমু না। সে জানায়, গ্রামের শরীফ মিয়া তার সঙ্গে খারাপ ব ̈বহার করে। খারাপ ইঙ্গিত দেয়। আমি গ্রামের সবাইকে কইয়া (বলে) দিছি। কুসুণ্ডা গ্রামের অনেকের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, শরিফ ’৭১ সালে রাজাকার ছিল। তখন সে গ্রামের হিন্দু-মুসলমানদের বাড়িঘর লুটতরাজ করেছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। মাঝে মাঝে এলেও থাকেনি। গত দুমাস ধরে নিয়মিত থাকছে। পরেশ হালদার জানায়, গত পনের-ষোল দিন আগে রবিবার রাতে সে বাড়ির অদূরে ধলেশ্বরী নদীতে জাল ফেলছিলো। হঠাৎ করে ১০/১২ জন ছেলে তার নৌকায় উঠে আসে। দু-চার কথা বলার পর বলে, দাদা দেশের পরিস্থিতি খুব খারাপ। আপনাদের ওপর লোকজন খুব খ্যাপা। ওদের ঠাণ্ডা করতে হবে। হাজার বিশেক টাকা দিবেন। হাউমাউ করে পরেশ একজনের পা চেপে ধরে। মন গলেনি চাঁদাবাজদের। যাওয়ার সময় ছেলেরা বলে যায়, টাকা দিলে ভালো। না হলে মুণ্ডু হারাতে হবে। শাসিয়ে যায় কাউকে বললে ভালো হবে না। রাতেই পরেশ ছুটে যায় গ্রামের মাতবরদের কাছে। সব কথা খুলে বলে। কিন্তু মাতবররাও কোনো ব্যবস্থা নিতে সাহস পায় না। পরেশ শরণাপন্ন হয় ̄স্থানীয় এক বিএনপি নেতার কাছে। বিচারে কলিম নামে এক যুবককে শাস্তি দেয়া হয়। তবে কলিম বলেছে, সে নাকি ঠাট্টা করে ওই কথা বলেছিল। কিন্তু তা যে ঠাট্টা ছিল না তা বোঝা গেল কয়েকদিন পরেই। বিভিন্ন লোক মারফত পরেশকে জানানো হয়, টাকা না দিলে দেশে টিকতে পারবে না। কেউ কেউ মধ্যতা করার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। বিশ হাজার টাকা না হোক কিছু কম দিয়ে হলেও মিটিয়ে ফেলা ভালো। সর্বশেষ গত রবিবার বলেছে, টাকা দিয়ে দাও না হলে দেশে থাকতে পারবে না। আরেকজন বলেছে, পিটুনি খেলেই টাকা বের হবে।

দৈনিক জনকন্ঠ, ৬ নবেম্বর ২০০১

মন্তব্য করুন