গাজীপুরের কালিয়াকৈরে এখনো হিন্দুদের ওপর নির্যাতন চলছে। গত সোমবার সকালে কালিয়াকৈর উপজেলার বোয়ালিয়া ইউনিয়নের জনৈক বাচ্চু মেম্বার জরুলাল, প্রসাদ ও সুবলকে ডেকে এনে ৪০ হাজার টাকা দাবি করে। এ ঘটনার খবর পেয়ে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের কয়েকজন নেতা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের নির্যাতনের ঘটনা জানতে পেরে সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের পঙ্কজ ভট্টাচার্য, আবুল বরকত দুলাল, ড. শিশির মজুমদার ও সমরজ্যোতি সাহা গতকাল সোমবার কালিয়াকৈরে যান। সকাল ৯টায় তারা কালিয়াকৈরে পৌঁছেই খবর পান যে, গাছবাড়ি গ্রামের তিনজন হিন্দুকে মুক্তিপণ আদায়ের লক্ষ্যে বোয়ালিয়া ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার নুরুল ইসলাম বাচ্চুর বাড়িতে আটকে রাখা হয়েছে। তাই শুরুতেই তারা গাছবাড়িয়া গ্রামে যান। সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ববৃন্দ ঘটনাস্থলে গিয়ে নুরুল ইসলাম বাচ্চুর কাছে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, জরুলাল, প্রসাদ ও সুবলের কাছে খামারের ভাড়া বাবদ তার ৪০ হাজার টাকা পাওনা আছে। পাওনা টাকা পরিশোধের জন্য তাদের ডেকে আনা হয়েছে। ধরে এনে আটকে রাখার অভিযোগ সত্য নয়। জরুলাল, প্রসাদ ও সুবল তিনজনই জানান, সকালবেলা মেম্বারের লোকজন তাদের মেম্বারের সঙ্গে দেখা করার নির্দেশ দেয় এবং হুমকি দিয়ে বলে, নয়তো পরে ধরে নিয়ে যাওয়া হবে। তারা তিনজনই জানান, খামার চাষ নিয়ে যে পাওনা টাকার দাবি মেম্বার করেছেন, তা তারা আগেই মধ্যবর্তী চাষীর কাছে পরিশোধ করে দিয়েছেন। নেতৃত্ববৃন্দ তাদের ছেড়ে দিতে বলে পরে গ্রামের সবাইকে নিয়ে সালিশ বৈঠক করার পরামর্শ দেন। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের নেতৃত্ববৃন্দ এরপর একই ইউনিয়নের শ্রীপুর ও গলুয়া গ্রাম পরিদর্শন করে নির্বাচন-উত্তর সহিংসতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ক্ষতিগ্রস্থ লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। শ্রীপুরের বাসিন্দাদের ৬০ শতাংশ হিন্দু হলেও তারা নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন বলে জানান। উৎকন্ঠার কারণেই তারা এবার দুর্গাপূজা করেননি। প্রতিবছর কার্তিক মাসে অষ্টপ্রহর নাম-সংকীর্তনের যে রেওয়াজ রয়েছে, এবার তাও হবে কি না তারা এখনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তারা জানান, এলাকার একটি মহল এখনো তাদের হুমকি-ধামকি দিয়ে যাচ্ছে। শ্রীপুরের তুলনায় গলুয়ার হিন্দুরা অনেক বেশী নির্যাতিত হয়েছেন। গত ৩ অক্টোবর বোয়ালিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সাধারণ সম্পাদক মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে গলুয়ায় দফায় দফায় আক্রমণ চালানো হয়। গলুয়া গ্রামের বাসিন্দা নরেন্দ্র নারায়ণ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গণেশ রায়ের বাড়িতে আক্রমণের অনেক চিহ্ন এখনো রয়েছে। আক্রান্ত লোকজন জানান, ৩ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে হামলাকারীরা প্রথমে গণেশ রায়ের বাড়িতে হানা দেয়। এ সময় গ্রামের হিন্দুদের সঙ্গে অনেক মুসলমানও প্রতিরোধ করার জন্য এগিয়ে এলে হামলাকারীরা পালিয়ে যায়। এরপর আবার দুপুর প্রায় ১২টায় হামলাকারীরা আরো লোকজন নিয়ে তিনদিক থেকে হামলা করে। হামলাকারীরা গণেশ রায়কে না পেয়ে তার স্ত্রী, কন্যা ও ভাইঝির ওপর নির্যাতন চালায়। দ্বিতীয়বার হামলার সময় নরেন্দ্র নারায়ণ উচ্চবিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ক্ষিতিশ রায় আহত হন। হাত-পা ব্যান্ডেজ বাঁধা অবস্থায় খুঁড়িয়ে হেঁটে এসে ক্ষিতিশ রায় ঘটনার বর্ণনা দেন। তিনি জানান, হামলাকারীরা লোহার রড ও হকিস্টিক দিয়ে পিটিয়ে তার দুহাত ও দুপা ভেঙ্গে দেয়। তারা ক্ষিতিশ রায়ের ছোট ভাই প্রভাত রায়ের বাম পা ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দেয়। গ্রামবাসী জানান, ৩ অক্টোবর হামলা ও লুটপাটের ঘটনায় খগেন্দ্রনাথ রায়, লক্ষণ মণ্ডল, প্রদীপ মণ্ডল, নিরোদ মণ্ডল, পাগল মণ্ডল, প্রফুল্ল সরকার, প্রহ্লাদ সরকার, বরুণ চন্দ্র সরকার, যাদব রায়, সুবল রায়, রসিকচন্দ্র রায় শারীরিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হিন্দুদের কেউই কোনো মামলা করেননি। বরং গাজীপুরের পুলিশসুপার সরেজমিন পরিদর্শন করে আসার পর সরকার বাদী হয়ে মামলা করতে পারে টের পেয়ে হামলাকারীরা ক্ষতিগ্রস্থদের কাছে এ এলাকায় এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি মর্মে লিখিত আদায়ের চেষ্টা চালাচ্ছে বলে এলাকাবাসী জানান।

প্রথম আলো, ৬ নবেম্বর ২০০১

মন্তব্য করুন