নির্বাচনের তারিখ যতই নিকটবর্তী হচ্ছে সংখ্যালঘু ভোটারদের ওপর বিভিন্ন স্থান থেকে অত্যাচার- নির্যাতনের অভিযোগ আসছে। সারা দেশেই ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে খবর এসেছে। চাঁদপুর, যশোর, নড়াইল, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, নোয়াখালী, পিরোজপুরের কয়েকটি স্থানে সংখ্যালঘু ভোটারদের অনিশ্চয়তাবোধ সৃষ্টি হয়েছে। গত শুক্রবার চাঁদপুরের কচুয়ার কয়েকটি এলাকায় তাদের বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। সংবাদদাতাদের পাঠানো খবরে দেখা যায়, এবারের নির্বাচনে একটি ব্যতিক্রমী দিক হচ্ছে সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভয়-ভীতি ছড়ানো। নির্বাচনী প্রচারের শুরু থেকে তাদের হুমকি-ধমকি দেয়া শুরু হয়েছিল। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, মৌলবাদী ও স্বাধীনতা বিরোধী অপশক্তি এবার বড় একটি রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে কুৎসিত চেহারা নিয়ে বেরিয়ে এসেছে। এদের কুমতলবও প্রকাশ হয়ে পড়েছে যে, সংখ্যালঘুরা যেন ভোট কেন্দ্রে না যায়। দেশের একটি অংশকে ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখতে পারলে মৌলবাদী ও স্বাধীনতাবিরোধীরা ফায়দা লুটতে পারবে বলে মনে করছে।
সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচন কমিশন না জানালেও জনসংখ্যার আনুপাতিক হারের ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে, এবার দেশে সংখ্যালঘু ভোটারের সংখ্যা প্রায় পৌনে এক কোটি। এদের মধ্যে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকই বেশি-প্রায় ৭০ লাখ। দেশের কয়েকটি আসন ছাড়া সংখ্যালঘুদের সংখ্যা তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। একটি ভ্রান্ত ধারণা থাকলেও গত কয়েকটি নির্বাচনের ফলাফলের নিরিখে দেখা যায়, সংখ্যালঘুরা সবাই বিশেষ কোন দল বা ব্যক্তির প্রতি আনুগত্য দেখায় না। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, মুন্সীগঞ্জ-১ আসনে গত তিনটি নির্বাচনে বিপুল ভোট পেয়ে বিএনপি প্রার্থী ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বিজয়। এ রকম দৃষ্টান্ত আরও
দেয়া যায়।
এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৬০ জন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সবচেয়ে বেশি প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন প্রগতিশীল শক্তি ১১ দলের ব্যানারে। এরপর আসছে আওয়ামী লীগ। এ দল থেকে ১৪ জনকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। জামায়াত ও ইসলামী ঐক্য জোটের সমন্বয়ে বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটেও ৫ জন প্রার্থীর মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। এমনকি এরশাদের ইসলামী ঐক্য ফ্রন্টও মনোনয়ন দিয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় থেকে। কয়েকটি আসনে সংখ্যালঘু প্রার্থীর মধ্যে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। শুধু তাই নয়, দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী সহিংসতায় চারদীয় জোটের কর্মী হিসাবে প্রতিদিন কোন না কোন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কর্মী আহত হওয়ার খবর আসছে। নির্বাচনের এমন সর্বজনীন পরিস্থিতির মধ্যে স্বাধীনতাবিরোধী ঘৃণ্য একটি দলসহ গত সংসদের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির ক্যাডাররা কয়েকটি অঞ্চলে সংখ্যালঘুদের ভয়ভীতি দেখাচ্ছে নিজেদের বিজয়কে নিশ্চিত করতে। যশোরের সদর থানার বাগডাঙা, বেজপাড়া, নলডাঙা, মনিরামপুর, কেশবপুর, বাঘারপাড়া ও ঝিকরগাছা থানার গ্রামে গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে গিয়ে ভোটের দিন ভোট কেন্দ্রে না যাওয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে। এমনও বলা হচ্ছে, ভোট কেন্দ্রে গেলে কাউকে বাংলাদেশে থাকতে দেয়া হবে না। জেলা পূজা পরিষদ এসব ঘটনার প্রেক্ষিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের গ্রামগুলোতে পুলিশ ক্যাম্প বসানোর জন্য রাষ্ট্রপতির কাছেও আবেদন করেছে।
পিরোজপুর-১ আসনে আওয়ামী লীগের সুধাংশু শেখর হালদারের বিরুদ্ধে এবারও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে ঘৃণ্য রাজাকার দিইল্যা ওরফে দেলোয়ার হোসেন সাঈদী। কয়েকদিন আগে সুধাংশু শেখর হালদারের সঙ্গে সাঈদী কোলাকুলি করলেও সেখানকার সংখ্যালঘুদের নানা হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে।
সর্বশেষ গত শুক্রবার চাঁদপুরের কচুয়ার কয়েকটি গ্রামে ও বাজারে বিএনপির ছত্রছায়ায় অশুভ শক্তি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নগ্ন হামলা চালায়। অনেকের বাড়িঘরে হামলা করা হয়। ভাংচুর ছাড়াও অগ্নিসংযোগ করার ঘটনাও ঘটে। বাজারে তাদের দোকানও ভাংচুর করা হয়। সে আসনের অন্যতম প্রার্থী ড. মহিউদ্দিন খান আলমগীরের ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র জানায়, সংখ্যালঘুদের ভোট দেয়া থেকে বিরত রাখতে উদ্দেশ্যমূলকভাবে একটি মুখচেনা মহল তাদের জীবনকে নিরাপত্তাহীন করে তুলতে চায়।
এক ইতিহাসবিদ বলেন, মৌলবাদী, ধর্মান্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তির কাছে সংখ্যালঘুরা অপ্রিয় হওয়ার অন্যতম কারণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাথে এদের বিশাল অবদান। ক্ষমতার বলয়ে উঠে আসতে মৌলবাদী, ধর্মান্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির পক্ষে জাতির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক উপায় নেই। তিনি মনে করেন, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও প্রগতিশীল শক্তির এখনই এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়া উচিত।
দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০১
কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন