দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত কিশোরগঞ্জ জেলার একটি প্রত্যন্ত হাওর জনপদের নাম ইটনা উপজেলা। মৎস সম্পদের অফুরন্ত ভাণ্ডার হিসাবে খ্যাত এ উপজেলাটিতে ‘জাল যার জলা তার’ নীতির আওতায় একসময় বিপুল সংখ্যক মৎসজীবি জেলে সম্প্রদায় মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু গত কয়েক বছর যাবৎ একশ্রেণীর প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার প্রভাবে আর অর্থের জোরে প্রচলিত নীতির ফাঁক-ফোকর গলিয়ে জমিদারি চালিয়ে যাচ্ছে উন্মুক্ত নদীগুলোতে। ফলে নদীর তীরবর্তী বিস্তির্ণ জনপদেও শত শত বছরের ঐতিহ্যবাহী হাজার হাজার হিন্দু মৎসজীবি জেলে সম্প্রদায়ের অস্তিত্বই আজ বিলুপ্ত প্রায়। বর্তমানে ইটনা উপজেলার উন্মুক্ত জলাশয়ে চলছে দোর্দণ্ড প্রতাপশালীদের একচ্ছত্র দাপট। তাদের লালিত লাঠিয়াল বাহিনীর দৌরাত্মে প্রকৃত জেলেরা এখন পেশাহারা। বন্ধ হয়ে গেছে তাদের জীবন জীবিকার পথ। আয়-রোজগারের অভাবে মারাত্মক দুঃখ-দৈন্যের মধ্যে কাটছে তাদের নিদারুণ মানবেতর জীবন। নিরন্ন জেলেরা অকাতরে শিকার হচ্ছে অকাল মৃত্যুর। দারিদ্রে ̈র নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত স্থানীয় মৎসজীবিদের ঘরে ঘরে বিরাজ করছে মৃত্যু বিভীষিকা। ভাগ্য বিড়ম্বিত এসব জেলের মধে সিংহভাগই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক। এলাকায় ব্যাপক ভাবে উত্থাপিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইটনা সদর ইউনিয়নের কয়েকটি জেলেপাড়া সরেজমিনে পরিদর্শন ও ব্যাপক অনুসন্ধানে এর সুস্পষ্ট সত্যতা পাওয়া যায়। এ সময় ইটনা উপজেলার ধনু নদী জেলে নৌকার সমাগমে মুখর থাকলেও এখন আর সে অবস্থা নেই। লাঠিয়াল বাহিনীর উন্মুক্ত সন্ত্রাসে বেশীরভাগ হিন্দু জেলে সম্প্রদায় দেশ ছেড়ে প্রতিবেশী দেশে আশ্রয় নিয়েছে। ইটনা সদরে এখন আর সেই ঐতিহ্যবাহী বিশাল বিশাল জেলে পল্লী নেই। এক থেকে দেড়শ সংখ্যালঘু জেলে পরিবার সদরের আনাচে-কানাচে কোনরকম ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। তাদের বর্তমান অর্থনৈতিক দৈন্যদশা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১ বছর শুধু ইটনা উপজেলা সদরেই ১৪ জন সংখ্যালঘু জেলে পরিবারের সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। মৃত ব্যক্তিরা হচ্ছেন পশ্চিম গ্রামের পিয়ারী বর্মণ, নরেন্দ্র বর্মণ, কৃষ্ণবাসি বর্মণ, কাচু বর্মণ, তুফানী বর্মণ ও কান্তি বর্মণ; মধ্য গ্রামের কালা বর্মণ, বৈকন্ঠ বর্মণ ও রামা বর্মণ, সিধী বর্মণ; পূর্ব গ্রামের অমর বর্মণ, বানী রানী বর্মণ ও মনিন্দ্র বর্মণ। এদের প্রায় সবাই অর্ধাহারে-অনাহারে এবং বিনা চিকিৎসায় ধুঁকে ধুঁকে অকাল মৃত্যুর শিকার হয়েছেন বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। প্রভাবশালীদের পোস্য লাঠিয়াল বাহিনীর ভয়ে ভীতসন্ত্রস্ত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলেরা এ প্রতিনিধির কাছে অভিযোগ করে বলেন, আমরা পেটের দায়ে একটা কনি জাল নিয়ে নদীর কিনারে গেলেও পাহারাদার নামধারী লাঠিয়ালরা আমাদের মারধর করে জাল কেড়ে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলে অথবা দীর্ঘদিনের জন্য জাল আটকে রেখে রোজগারের পথও বন্ধ করে দেয়। জেলেরা দূর-দূরান্ত থেকে কিছু গুড়া (ছোট) মাছ ধরে নিয়ে এলেও উপজেলা সদরের ধনু নদীর তীরে এলেই তাদেরকে মারপিট করে সমুদয় মাছ রেখে দেয়া হয় বলে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কথিত প্রভাবশালীকে মোটা অঙ্কের খাজনার টাকা পরিশোধ না করে উন্মুক্ত নদীতে জাল ফেলানোর সাজা আরো ভয়ঙ্কর। এক্ষেত্রে কথিত প্রভাবশালীর লোকজনেরা শীতের রাত্রিতে নদীতে বাঁশ কুপে জেলেদের পিঠমোড়া করে ঘন্টার পর ঘন্টা পানিতে বেঁধে রাখে। এ ধরণের বর্বরোচিত নির্যাতনের ঘটনা ও ক্ষুধার জ্বালা মুখ বুজে সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। বিকল্প পথ খুঁজলেই প্রশাসনিক হয়রানির নিশ্চিত খড়গ নেমে আসে তাদের ওপর, এ ধারণাই পাওয়া যায় জেলেদের সাথে কথা বলে। এছাড়া উপজেলার পাঁচহাটের উন্মুক্ত জলাশয়, এলংজুড়ির উন্মুক্ত নদী ও বাদলা থানেশ্বরের উন্মুক্ত নদীতেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙ্গিয়ে প্রভাবশালীদের উন্মত্ততা চলছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এমন সংকটাপন্ন অব স্থায় ভূমিমন্ত্রী ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রভাবশালীদের অবিলম্বে উচ্ছেদপূর্বক উন্মুক্ত জলমহাল নীতির সঠিক বাস্তবায়ন ঘটলেই সমস্যার সমাধান সম্ভব।

সংবাদ, ১০ ডিসেম্বর ২০০১

মন্তব্য করুন