তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নির্বাচন-পূর্ব ৭৭ দিনে সারাদেশে ব্যাপক রাজনৈতিক সহিংসতা, বোমা বিস্ফোরণ এবং সংখ্যালঘু ও আদিবাসীদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এমনকি খোদ ঢাকা মহানগরীতেও সংখ্যালঘুরা হুমকির মুখে। এ সময় পুলিশ এবং সেনাবাহিনীও কয়েক জায়গায় সহিংস আচরণ করেছে। দেশের কমপক্ষে ৩৩টি জেলায় সংখ্যালঘুরা হুমকি ও চাপের মুখে রয়েছে। কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না তারা ভোট দিতে পারবে কিনা। আজ ভোটের দিনেও মুন্সীগঞ্জে চলেছে হরতাল। গতকাল পর্যন্ত সারাদেশে নির্বাচনী সহিংসতায় ১৬৩ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে ৬ হাজারেরও বেশি। দেশের এমন কোনো নির্বাচনী এলাকা এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন যেখানে রাজনৈতিক হাঙ্গামা ও সহিংসতা ঘটেনি। তবে এর মধ্যে ঢাকা মহানগরী ছিলো মোটামুটি শান্ত। দু-চারটি ঘটনা ছাড়া নগরীতে ব্যাপক কোনো রাজনৈতিক সহিংস ঘটনা ঘটেনি। পুলিশের পাশাপাশি বিডিআর ও সেনাবাহিনী নিয়োগ করেও রাজনৈতিক সহিংসতার লাগাম টেনে ধরা যায়নি। সেনাবাহিনী নিয়োগের পরবর্তী ১০ দিনেই সর্বোচ্চ ৩৭টি খুন হয়েছে রাজনৈতিক সহিংসতায়। বিডিআরের গুলিতেও নিহত হয়েছে ৪ জন। এ ১০ দিনেই আহত হয়েছে ২ হাজার ৫০০ নেতা-কর্মী।

অন্যদিকে নির্বাচন-পূর্ব শেষ মাস সেপ্টেম্বরে খুন হয়েছে সর্বোচ্চ ৮২ জন। গত ৭৭ দিনে সারাদেশে নিহত ১৬৩ জন নেতা-কর্মীর মধ্যে কমবেশি চতুর্থাংশ আ.লীগের নেতা-কর্মী। গত ১০ দিনে যে ৩৭টি খুন হয়েছে তার মধ্যে বিএনপির মাত্র ৪ জন। বাকিরা আ. লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মী এবং নিরীহ জনসাধারণ। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সবচেয়ে মর্মন্তুদ ঘটনা ঘটে চলতি মাসের ২৩ সেপ্টেম্বর বাগেরহাটে। বাগেরহাটের মোল্লাহাটে আ. লীগ প্রার্থী শেখ হেলালের নির্বাচনী জনসভায় টাইম বোমা বিস্ফোরণে ৮ জন নিহত হয়। বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় শেখ হেলালও আহত হন। তিনি অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। এর মাত্র ৪ দিনের মাথায় সিলেটের সুনামগঞ্জের শারলা এলাকায় আ. লীগ প্রার্থী সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের জনসভাস্থলের অল্প দূরে বোমা বিস্ফোরণে ৪ জন নিহত হয়। ওই জনসভায় আ. লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ দেয়ার কথা ছিল। গোয়েন্দা সংস্থার ধারণা, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যেই ওই বোমা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছিলো। বাংলাদেশের ইতিহাসে কোনো নির্বাচনী জনসভায় টাইম বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেই প্রথম ঘটেছে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রোববার সর্বশেষ নিবাচনী সহিংসতা ঘটেছে মুন্সিগঞ্জে। গত শনিবার বিএনপির সন্ত্রাসীরা সেখানে হত্যা করেছে। ঢাকা থেকে লাশ মুন্সিগঞ্জে নেয়ার পথে মোক্তারপুর ফেরিঘাটেও সন্ত্রাসীরা বাধা দেয়। এ ঘটনার প্রতিবাদে মুন্সীগঞ্জে গতকাল থেকে লাগাতার হরতাল চলছে। সেনা সদস্যরা শনিবার মুন্সিগঞ্জে আ. লীগ নেতা-কর্মীদের ওপর দু-দফা গুলিবর্ষণ করে।

অন্যদিকে রাজশাহী এলাকায়ও সেনা সদস্যরা নির্যাতন চালাচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত শুক্রবার বিডিআর সদস্যরা ফটিকছড়িতে গুলি করে ৪ জন আ. লীগ নেতা-কর্মীকে হত্যা করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় সবচেয়ে বেশি নির্বাচনী সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে ভোলা ও ফেনী এলাকায়। গত শনিবার মুন্সীগঞ্জ, ভোলা, ফেনী, মৌলভীবাজার, কুষ্টিয়া, নওগাঁ, নোয়াখালী ও চাঁদপুরে নির্বাচনী সহিংসতায় খুন হয়েছে ১০ জন। গত ১৫ জুলাই রাতে তত্ত্ববধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই সারাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হয়। শুরু করে বিএনপি আ.লীগের বিরুদ্ধে। এরপর তা জাতীয় পার্টি ও জামায়াতের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে ক্রমান্বয়ে বেড়ে যায়। নির্বাচনের আগের দিন গতকাল রোববার পর্যন্ত তা নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে রাজনৈতিক সহিংসতায় জুলাই মাসের শেষ ১৬ দিনে ১৯, আগস্ট মাসে ৬২ এবং সেপ্টেম্বর মাসে ৮২ জন খুন হয়েছে। নির্বাচনী সহিংসতায় প্রার্থীর গাড়িতে হামলা ও গুলি, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া ছাড়াও নতুন মাত্রা যোগ হয় বরিশালের হিজলা উপজেলায়। গত ২৪ জুলাই বিএনপির সন্ত্রাসীরা আ. লীগের নেতা-কর্মী বহনকারী একটি ট্রলার নদীতে ডুবিয়ে দেয়। যাত্রীরা সাঁতার কেটে তীরে উঠেও রক্ষা পায়নি। সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পোড়ানো ও হুমকির পাশাপাশি মন্দির ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনাও ঘটেছে। ১৭ সেপ্টেম্বর মানিকগঞ্জে দুটি মন্দির ও তিনটি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। দেশের কমপক্ষে ৩৩টি জেলায় সংখ্যালঘুরা নির্যাতন ও হুমকির শিকার হয়েছে। তাদের ভোট দেয়া এখনো অনিশ্চয়তার মুখে। নির্বাচনী সহিংসতা থেকে এবার জাতীয় পতাকা ও চিত্রশিল্পীরাও রেহাই পায়নি। গত ২২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সামনে ছাত্রদল নেতা মামুনের নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা মৌলবাদবিরোধী কার্টুন ভাঙচুর করে ও জাতীয় পতাকা পুড়িয়ে দেয়। লাঞ্ছিত করে চিত্রশিল্পীদের। দেশের ৩৩টি জেলার সংখ্যালঘুরা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। জেলাগুলো হলো ভোলা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, নড়াইল, যশোর, চট্টগ্রাম, খুলনা, নওগাঁ, নাটোর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ, সুনামগঞ্জ, বরিশাল, নোয়াখালী, লক্ষীপুর, ঝিনাইদহ, সাতক্ষীরা, ফরিদপুর, দিনাজপুর, রংপুর, মাগুরা,
রাজবাড়ি, নেত্রকোনা। এছাড়া ঢাকায়ও সংখ্যালঘুরা হুমকির মুখে আছে।

সংবাদ, ১ অক্টোবর ২০০১
কৃতজ্ঞতা: শ্বেতপত্র-বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ১৫০০ দিন

মন্তব্য করুন